ক্যান্সার বা কর্কটরোগ কি?
জীবদেহের গঠন ও কাজের ক্ষুদ্রতম একক হলো কোষ যা একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টি করে। কোনো কারণে কোষ বিভাজনের এই নিয়মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে গেলে মাত্রাতিরিক্ত কোষ সৃষ্টি হয় এবং তা মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়ে টিউমার সৃষ্টি করে। টিউমার দুই প্রকার- বিনাইন এবং ম্যালিগন্যান্ট। টিউমার কোষকে নিউপ্লাস্টিক কোষ বলে। যে টিউমারের নিউপ্লাস্টিক কোষ আশেপাশের সুস্থ টিস্যু ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বলে। আর যে টিউমারের নিউপ্লাস্টিক কোষের ভেদনক্ষমতা নেই, সেটি বিনাইন টিউমার। প্রকৃতপক্ষে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকেই ক্যান্সার বলা হয়।
ক্যান্সারের প্রকারভেদ
আক্রান্ত স্থান ভেদে ক্যান্সার বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমনঃ
- স্তন ক্যান্সার
- ফুসফুস ও শ্বাসনালী ক্যান্সার
- মলাশয় এবং মলদ্বার ক্যান্সার
- লিউকেমিয়া (রক্ত ক্যান্সার)
- অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার
- লিভার ক্যান্সার
- পাকস্থলী ক্যান্সার
- ত্বক ক্যান্সার
- মস্তিষ্কের ক্যান্সার ইত্যাদি
বাংলাদেশে ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব
পৃথিবীতে ঘাতক রোগের শীর্ষে থাকা প্রধান একটি মরণব্যাধি হলো ক্যান্সার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে শুধু ২০২০ সালেই ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে প্রায় ১ কোটি রোগী মারা যায় এবং ক্যান্সারে মৃত্যুহার প্রায় প্রতি ৬ জনে ১ জন। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪ লক্ষ শিশু ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাবে প্রতি বছর বৈশ্বিক ১.১৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দুই লক্ষ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লক্ষ ক্যান্সার রোগী রয়েছে এবং প্রতি বছর প্রায় দেড় লক্ষ ক্যান্সার রোগী মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ১০% মৃত্যু হয় ক্যান্সারের কারণে এবং এটি ৬ষ্ঠ মৃত্যু সংঘটক কারণ। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ক্যান্সারের মধ্যে মৃত্যুহারের দিক থেকে ফুসফুস ও শ্বাসনালীর ক্যান্সার প্রথম, মলদ্বারের ক্যান্সার দ্বিতীয় এবং অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার তৃতীয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরুষদের ফুসফুস ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, শ্বাসনালীর ক্যান্সার ও পাকস্থলীর ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বেশি এবং মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার ও জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেশি।
বাংলাদেশে প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে ১ টি হাসপাতাল বেড ও ১ জন চিকিৎসক ও নেই বলে উন্নত ও সহজলভ্য ক্যান্সার চিকিৎসা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আক্রান্ত রোগী ও রোগের প্রাদুর্ভাব বিবেচনা করে আমাদের দেশে অন্তত ১৬০ টি ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র প্রয়োজন।
কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে মাত্র ১৫টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ক্যান্সার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। এছাড়াও কিছু প্রাইভেট হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা চালু হলেও তার ব্যয় অনেক বেশি। এ অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ২০০৭ সালে ‘জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনা’ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা কেন্দ্রীক ক্যান্সার সেবাকে বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ২০১৯ সালে ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আট বিভাগের সকল সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার সেবা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ক্যান্সারের কারণ কি কি?
১. বয়সঃ
যেকোনো বয়সেই ক্যান্সার হতে পারে। তবে সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান যেমন সূর্যের আলো, অতিবেগুনী রশ্মি, ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, ক্যান্সারে সহায়ক খাদ্য উপাদান ইত্যাদির অধিক সংস্পর্শে আসে বলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে যে অর্ধেকেরও বেশি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর বয়স ৬৬ বছর বা তার বেশি।
২. পারিবারিক ইতিহাসঃ
পরিবারের কেউ ক্যান্সার আক্রান্ত থাকলে অন্যদের ও জিনগত কারণে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা থাকে। প্রায় ১০% ক্যান্সার বংশানুক্রমিকভাবে হয়ে থাকে।
৩. খাদ্যঃ
বেশ কিছু খাবার ক্যান্সার সৃষ্টি করে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। যেমনঃ
- প্রক্রিয়াজাত মাংস
- অতিরিক্ত চিনি এবং লবণযুক্ত খাবার
- পরিশোধিত শর্করা
- মদ
- বিড়ি সিগারেট
- পান সুপারি
- জর্দা
- ফাস্ট ফুড ইত্যাদি
৪. জীবনযাপনের রীতিঃ
জীবনযাপনের কিছু খারাপ রীতি ক্যান্সার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। যেমনঃ
- অলসতা এবং কায়িক পরিশ্রম না করা
- স্থূলতা
- ক্যান্সার সৃষ্টিকারী খাদ্যাভ্যাস
- মাদকাসক্তি (ধূমপান, মদ্যপান)
- মাসিক চলাকালীন যৌন অপরিচ্ছন্নতা
৫. পরিবেশ ও কর্মজীবনঃ
বেশিরভাগ ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই পরিবেশ ও কর্মজীবনের কিছু রাসায়নিক উপাদান মূখ্য ভূমিকা রাখে। যেমনঃ
- বায়ু দূষণ
- অতিবেগুনী রশ্মি
- রেডন গ্যাস
- এসবেস্টস
- ফরমালডিহাইড
- কাঠের ধূলা
- ভিনাইল ক্লোরাইড
- আফ্লা টক্সিন
- ক্রোমিয়াম
- আর্সেনিক
- ক্যাডমিয়াম
- বেনজিন
- বেরিলিয়াম
- নিকেল ইত্যাদি
৬. ভাইরাসঃ
- ভাইরাস (হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি, এবস্টেইন বার ভাইরাস, সাইটোমেগালো ভাইরাস),
- পরজীবী (সিস্টোসোমিয়াসিস)
ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গ কি কি?
মানবদেহে অঙ্গভেদে ক্যান্সারের লক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণ কিছু লক্ষণ হলোঃ
- শরীরে অস্বাভাবিক মাংসপিন্ড
- ঘন ঘন জ্বর
- ক্ষুধামন্দা
- ডায়রিয়া
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- ত্বকের অস্বাভাবিক পরিবর্তন
- অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস
- অস্বাভাবিক রক্তপাত
- মানসিক অস্বস্তি
- মলত্যাগে রক্ত যাওয়া
- অবসাদ এবং দুর্বলতা
- পেট ব্যথা
- রক্তসহ কফ কাশি ইত্যাদি
ক্যান্সার প্রতিরোধ
- নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম
- অতিরিক্ত চিনি, চর্বি, লবণযুক্ত এবং ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার পরিহার
- প্রখর রোদ পরিহার
- মদ, ধূমপান, পান, তামাক, জর্দা সহ সব নেশাদ্রব্য পরিহার
- যৌন সংক্রমণ থেকে রক্ষা
ক্যান্সার নির্ণয়
- রক্ত পরীক্ষা
- ইমেজিং টেস্ট (আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এম আর আই ইত্যাদি)
- ক্যান্সার টিস্যু বায়োপসি
- পি ই টি স্ক্যান ইত্যাদি
ক্যান্সার চিকিৎসা
রোগীর ক্যান্সারের ধরন, আক্রান্ত অঙ্গ, প্রকৃতি, কতটুক ছড়িয়েছে, ক্যান্সারের বর্তমান ধাপ, চিকিৎসার সহজলভ্যতা, ব্যয়, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়। ক্যান্সার চিকিৎসা পদ্ধতি গুলো হলোঃ
১. অপারেশনঃ লিউকেমিয়া বা রক্ত ক্যান্সার ছাড়া বাকী সব ক্ষেত্রে যদি ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে এবং বেশি না ছড়ায় তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তাররা অপারেশনের মাধ্যমে ক্যান্সার আক্রান্ত টিউমার কোষগুলো কেটে ফেলেন।
২. কেমোথেরাপিঃ এ পদ্ধতিতে ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে দেহের অতিরিক্ত বিভাজনক্ষম কোষগুলোকে ধ্বংস করা হয়। প্রায় ৫০ ধরনের এন্টি ক্যান্সার বা সাইটোটক্সিক ওষুধ রয়েছে। এই ওষুধগুলো ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল আকারে থাকলেও সাধারণত স্যালাইনের সাথে মিশিয়ে শরীরে প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিতে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও ক্যান্সার চিকিৎসায় এটি সবচেয়ে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। ব্যাপক বর্ধনশীল ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করতে এটি খুব কার্যকরী।
৩. রেডিওথেরাপিঃ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষগুলোর ডিএনএ ধ্বংস করে টিউমারকে সংকুচিত করে এই চিকিৎসা করা হয়।
ক্যান্সারের আরো কিছু অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো হলোঃ
৪. সুনির্দিষ্ট ওষুধ প্রয়োগঃ এই পদ্ধতিতে ক্যান্সারের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এটি অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে একত্রে প্রয়োগ করা হয়। টিউমার কোষগুলোর নিৰ্দিষ্ট জিন, প্রোটিন বা কোষের পরিবেশ, যা ক্যান্সার ছড়াতে সাহায্য করে, সেই অংশগুলিকে লক্ষ্য করে এই চিকিৎসা করা হয়।
৫. ইমিউনোথেরাপিঃ একে বায়োলজিকাল থেরাপি ও বলা হয়। এ পদ্ধতিতে মানবদেহে উৎপন্ন নিজস্ব উপাদান অথবা গবেষণাগারে উৎপন্ন উপাদান দেহে প্রবেশ করিয়ে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ক্যান্সার চিকিৎসা করা হয়।
৬. হরমোন থেরাপিঃ মানবদেহের কিছু অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোন বিভিন্ন ক্যান্সার যেমনঃ ব্রেস্ট ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার ইত্যাদি সৃষ্টি করে। হরমোন থেরাপিতে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে বিশেষ কিছু ওষুধ প্রয়োগ করে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হরমোন ক্ষরণ কমিয়ে ক্যান্সারের বিস্তৃতি রোধ করে। অনেকক্ষেত্রে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ওইসব অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকে সার্জারী করে কেটে ফেলা হয়।
৭. অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনঃ একে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট, স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট ও বলা হয়। মাল্টিপল মায়ালোমা চিকিৎসায় এটি বেশ কার্যকরী। দেহের ক্ষতিগ্রস্ত ও রোগাক্রান্ত অস্থিমজ্জাকে সুস্থ অস্থিমজ্জা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়।
৮. সহায়ক চিকিৎসাঃ ক্যান্সারের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসা প্রদানেও জোর দেন চিকিৎসকরা। স্বাভাবিকভাবেই ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়েন। যোগ, মেডিটেশন ইত্যাদির মাধ্যমে তাদেরকে মানসিকভাবে দৃঢ় ও প্রফুল্ল থাকার অনুপ্রেরণা দেয়া হয়।