বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ এবং দেশের অনেক মানুষ অপুষ্টি, সংক্রামক রোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি স্নায়বিক ব্যাধিতে ভোগে। দেশে জাতীয় পরিসংখ্যান না থাকা সত্ত্বেও কিছু হাসপাতাল-ভিত্তিক গবেষণা দ্বারা বাংলাদেশে মৃগী রোগের কিছু ধারণা পাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলোতে প্রতি ১০০০ জনে এই রোগের হার প্রায় ৫ জন, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সংখ্যা আরো বেশি।
বাংলাদেশে মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রতি ১০০০ জনে ৮.৪ জন। নারীদের তুলনায় পুরুষদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এবং শহরের মানুষদের তুলনায় গ্রামীণ এলাকার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গ্রামীণ সমাজের দেখা যায় যে মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই ডাক্তারের কাছে সাহায্য নেয় না কারণ তারা মনে করে মৃগী রোগের কোন নিরাময় নেই। উপরন্তু তারা কবিরাজ, ওঝা এবং আধ্যাত্মিক নিরাময়ের উপায় খোঁজেন।
মৃগী রোগের কারণ
মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সংকেতগুলি এলোমেলো এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এ রোগে আক্রান্ত প্রায় এক-তৃতীয়াংশের পরিবারের এমন অন্য এক বা একাধিক সদস্য রয়েছে যাদেরও মৃগীরোগ আছে। এর থেকে স্পষ্ট হয় যে আপনার মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে তার সাথে আপনার জেনেটিক্যাল (Genetical) সম্পর্ক রয়েছে। মস্তিষ্কের নিম্নলিখিত ক্ষতির কারণেও মৃগী রোগ হতে পারে, যেমন:
- স্ট্রোক (Stroke)
- মস্তিষ্কে টিউমার
- মাথায় গুরুতর ক্ষত
- ড্রাগস বা অ্যালকোহল অপব্যবহার
- মস্তিষ্কে ভাইরাল ইনফেকশন
- জন্মের সময় পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব
বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ মানুষ বিশ্বাস করে যে মৃগী রোগ জাদু-বিদ্যা দ্বারা হয়। এখনও, অনেক পিতামাতা এবং সাধারণ মানুষ মৃগীরোগ এর আসল কারণ বুঝতে পারে না। তাই তারা মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, শিক্ষিত, পুনর্বাসন এবং তাদের অন্যান্য সামাজিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে পারেন না।
মৃগী রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ
মস্তিষ্কের কোন অংশকে প্রভাবিত করে তার উপর নির্ভর করে, খিঁচুনি বিভিন্ন ব্যক্তির উপর বিভিন্ন প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু সম্ভাব্য লক্ষণ নিচে দেওয়া হল:
- শরীরের যেকোনো অংশে ঝাঁকুনি (Jerking) এবং কাঁপুনি (Shaking) হবে।
- কোন কারন ছাড়াই যে কোনো দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা।
- অস্বাভাবিক অনুভূত হওয়া, বাজে গন্ধ বা স্বাদ, এবং বাহুতে বা পায়ে শিহরণ।
- হঠাৎ করে কিছু সময় পার হয়ে যাওয়া এবং কি ঘটেছে তা মনে করতে না পারা।
- পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া।
এছাড়াও হাত ও পায়ের অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকুনি এবং মনস্তাত্ত্বিক লক্ষণ যেমন ভয়, উদ্বেগ এবং চেতনা হারানো ইত্যাদি ও মৃগীরোগের কিছু উল্লেখযোগ্য লক্ষন।
![শিশুর খিঁচুনি বা মৃগীরোগ Epilepsy](https://sasthodarpan.com/wp-content/uploads/2024/02/istockphoto-1238969353-612x612-1-300x300.jpeg)
কিভাবে মৃগী রোগের চিকিৎসা করা হয়
মৃগী রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীরই খিঁচুনি বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে ক্ষতির প্রবণতা কমিয়ে আনা হয়। এক্ষেত্রে, ঔষধ দিয়ে ৭০-৮০ ভাগ রোগীর খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এইসব ঔষধ খিঁচুনি বিরোধী এবং মৃগীরোগের চিকিৎসার প্রধান উপায়। বর্তমানে, খিঁচুনি রোগের অনেক ধরনের ওষুধ রয়েছে যেমন- কার্বামাজেপাইন (Carbamazepine) , ক্লোনাজেপাম (Clonazepam), ইথোসাক্সিমাইড (Ethosuximide), গ্যাবাপেন্টিন (Gabapentin), ল্যাকোসামাইড (Lacosamide), অক্সাকার্বাজেপাইন (Oxcarbazepine), ফেনোবারবিটাল (Phenobarbital), ফেনাইটোইন (Phenytoin), প্রিগাবালিন (Pregabalin), সোডিয়াম ভালপোরেট (Sodium valproate), টপিরামেট (Topiramate), এবং ভিগাবাট্রিন (Vigabatrin) ইত্যাদি।
ঔষধ ব্যতীত ভিন্ন কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি হল:
- মস্তিষ্কের একটি ছোট অংশ যার জন্য খিঁচুনি সৃষ্টি হয় অস্ত্রোপচারের সময় অপসারণ করা।
- শরীরের ভিতরে একটি ছোট বৈদ্যুতিক যন্ত্র রাখা যা খিঁচুনি বন্ধ করতে সাহায্য করতে পারে।
- কেটোজেনিক ডায়েট (Ketogenic diet) নামক একটি বিশেষ খাদ্য পদ্ধতি খিঁচুনি বন্ধ করতে সাহায্য করে।
জরুরি অবস্থায় উপদেশ:
জোরপূর্বক দাঁত খোলার চেষ্টা করা উচিত নয়। শর্ট বা টাইট কাপড় পরা থাকলে ঢিলা করা এবং সম্ভব হলে রোগীকে নিরাপদ স্থানে নেয়া। খিঁচুনি আক্রান্ত ব্যক্তির চারদিকে ভিড় না করা।
মৃগীরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী?
কিছু লোক যে কোনও ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থেকে অসুস্থ হতে পারে। এজন্য একটি নতুন ঔষধ গ্রহণ শুরু করার আগে, সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ডাক্তারের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। অ্যান্টি-এপিলেপটিক (Anti-epileptic) ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, শক্তির অভাব, মাথাব্যথা, অনিয়ন্ত্রিত কম্পন, চুল পড়া বা অবাঞ্ছিত চুল বৃদ্ধি, ফোলা মাড়ি, ফুসকুড়ি ইত্যাদি। আপনার যদি ফুসকুড়ি হয় তবে বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন, কারণ অ্যান্টি-এপিলেপটিক ড্রাগের অন্যতম মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে স্টিভেনস-জনসন সিন্ড্রোম (Stevens–Johnson syndrome)। এটি একটি প্রাণঘাতী ত্বকের অবস্থা এবং অতি সংবেদনশীলতা কমপ্লেক্স দ্বারা সৃষ্ট, যা ত্বক এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লিকে প্রভাবিত করে। এই সিন্ড্রোমটি মৃগীরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের প্রয়োগের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
মৃগীরোগের ওষুধ খাওয়ার পরও খিঁচুনি হলে কী করণীয়?
মৃগীরোগের ওষুধ খাওয়ার পরও খিঁচুনি বন্ধ না হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এর সমাধানের জন্য ওষুধের ডোজ বা কখন সেবন করতে হবে তা পরিবর্তন করতে হবে। খিঁচুনি হওয়ার একটি সাধারণ কারণ হল রোগীরা তাদের ওষুধ সঠিকভাবে গ্রহণ করে না। তবে চূড়ান্ত ক্ষেত্রে কি করণীয় তা নিশ্চিত না হলে, আপনার ডাক্তার বা ফার্মাসিস্ট সাহায্য করতে পারেন। কোন ব্যক্তি যদি একটি ওষুধ তার সর্বোচ্চ ডোজ পর্যন্ত সঠিকভাবে গ্রহণ করেন এবং তারপরও খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য না হয়, তাহলে তাকে একটি ভিন্ন ওষুধ চেষ্টা করতে বলা হতে পারে। যদি এটিও কাজ না করে, তাহলে রোগীকে দুটি ওষুধ একসাথে খেতে বলা হয়।
মৃগী রোগ কি নিরাময়যোগ্য?
মৃগী রোগ নিরাময়যোগ্য কি না, সেটি এক কথায় বলা খুব কঠিন। সাধারণত সেকেন্ডারি খিঁচুনি (Secondary generalized seizure) যেটি, সেটি অনেক সময় নিরাময় করা যায়। যেমন মস্তিষ্কের টিউমারের জন্য একজন রোগীর খিঁচুনি হচ্ছে, তো সে ক্ষেত্রে টিউমার অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিলে এবং তার যে আনুষাঙ্গিক চিকিৎসা রয়েছে সেগুলো করলে নিরাময় হতে পারে। কিন্তু টিউমার ক্যানসার জাতীয় হলে, ক্যামোথেরাপি, রেডিওথেরাপির মাধ্যমে একে নিরাময় করা সম্ভব। প্রাইমারি এপিলেপসি (Primary generalized) দীর্ঘদিন যাবত ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো হয়ে যায়। তবে ১০০ জনের মধ্যে ১০০ জনই ভালো হয়ে যায়, এটা বলা ভুল হবে। কেননা ৫-১০ ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সব ওষুধ প্রয়োগ করার পরও রোগটা ভালো হচ্ছে না। এই ধরনের মৃগীরোগ কে বলা হয় রিফ্লেক্টোরি এপিলেপসি (Refractory Epilepsy)।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১.৫-২ মিলিয়ন মৃগীরোগী রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে খিঁচুনি রোগ বিষয়ে একটি জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা হয়েছে। এই রোগের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করণে নিম্নলিখিত সত্য বিষয়গুলো বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি:
- সঠিক ও নিয়ন্ত্রিত চিকিৎসা দিয়ে এ রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
- রোগীর স্কুলে বা কার্যক্ষেত্রে যেতে বাধা নেই।
- এ রোগ ছোঁয়াচে নয়, তাই এ রোগীর সাথে মেলামেশা করতে বাধা নেই।
মৃগীরোগ যেকোন বয়সে দেখা দিতে পারে, তবে বেশিরভাগ রোগীই সাধারনত শিশু বা ৬০ বছরের বেশি বয়সী। এটি সাধারণত সম্পূর্ণ জীবন কাল স্থায়ী হয়, তবে কখনও কখনও সময়ের সাথে ধীরে ধীরে রোগী সুস্থ হয়ে যেতে পারে। জনসচেতনতা বাড়ানো, প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা প্যাকেজের মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবধান হ্রাস করা বাংলাদেশে খিঁচুনি রোগ ব্যাবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হতে পারে। স্বাস্থ্য কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ, মানসিক স্বাস্থ্য গ্যাপ অ্যাকশন প্রোগ্রাম ইত্যাদি সমগ্র বিশ্বে এবং বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মৃগী রোগীদের কল্যাণ ও সুরক্ষায় অসামান্য অবদান রাখতে পারে।
রেফারেন্স
- Harris R. Points: Epilepsy and learning. British Medical Journal. 1979 Apr 4;1(6168):958.
- Tellez-Zenteno JF, Hernandez-Ronquillo L. Epidemiology of neurocysticercosis and epilepsy, is everything described?. Epilepsy & Behavior. 2017 Nov 1;76:146-50.