ক্যান্সার প্রতিরোধ – প্রয়োজন সচেতনতা এবং সম্মিলিত উদ্যোগ

ক্যান্সার প্রতিরোধ – প্রয়োজন সচেতনতা এবং সম্মিলিত উদ্যোগ 

316 বার পড়া হয়েছে

সাইক্লোফসফামাইডঃ 

ডোজেজঃ বাচ্চা এবং পরিণত বয়স্ক উভয়ের ক্ষেত্রেই এই ওষুধের ডোজ সাধারণত শরীরের প্রতি কেজি ভরের জন্য প্রতিদিন ১-৫ মিলিগ্রাম সাইক্লোফসফামাইড দেয়া হয়। চিকিৎসক রোগ ও রোগীর অবস্থা বুঝে ডোজের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করেন৷ 

ট্যাবলেটঃ ২৫ মিগ্রা, ৫০ মিগ্রা 

ইঞ্জেকশন পাউডারঃ ৫০০ মিগ্রা, ১ গ্রাম, ২ গ্রাম 

আইভি (সবিরাম)- ৪০-৫০ মিগ্রা/ কেজি, ২-৫ দিন ধরে, ২-৪ সপ্তাহ পরে আবার একই ডোজেজ দেয়া যাবে৷ 

আইভি (অবিরাম)- ৬০-১২০ মিগ্রা/মি প্রতিদিন 

ওরাল (সবিরাম)- ৪০০-১০০০ মিগ্রা/মি, ৪-৫ দিন 

ওরাল (অবিরাম)- ১-৫ মিগ্রা/ কেজি প্রতিদিন 

বৃক্ক রোগের ক্ষেত্রে, ২-৩ মিগ্রা/কেজি প্রতিদিন, ১২ দিন পর্যন্ত যদি কর্টিকোস্টেরয়েড কাজ না করে।

ক্রিয়াকৌশলঃ সাইক্লোফসফামাইড এক ধরনের অ্যালকাইলেটিং এজেন্ট যা একক বা অন্যান্য ওষুধের সাথে মিশ্রণ করে কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত হয়। এই শ্রেণীর ওষুধগুলো  তিনটি ভিন্ন প্রক্রিয়া দ্বারা কাজ করেঃ 

১. অ্যালকাইল গ্রুপ কে ডিএনএ বেস জোড়ার সাথে সংযোগের ফলে ডিএনএ রিপেয়ার এনজাইম এসব অ্যালকাইলেটেড বেসকে প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে ডিএনএকে খন্ড খন্ড করে ফেলে। ফলে ডিএনএ সংশ্লেষণ এবং আক্রান্ত ডিএনএ থেকে আরএনএ সংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ক্যান্সার কোষ মারা যায়। 

২. ডিএনএ অণুগুলোর মধ্যকার বন্ধন বা ক্রসলিংকগুলো ডিএনএকে পৃথক হতে দেয় না। ফলে নতুন ডিএনএ প্রতিলিপি এবং আরএনএ সংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্যান্সার কোষ মারা যায়।

৩. নিউক্লিওটাইডগুলোর ভুল জোড়াবন্ধন মিউটেশন ঘটায় এবং ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে। 

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ 

  • বমি
  • ক্ষুধামন্দা 
  • ওজন হ্রাস 
  • তলপেটে ব্যথা
  • ডায়রিয়া 
  • চুল পড়া
  • মুখে ও জিহ্বায় ঘা
  • ত্বক, আঙ্গুল, পায়ের পাতার রঙ ও বৃদ্ধি পরিবর্তন 
  • গলাব্যথা 
  • জ্বর 
  • অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ 
  • ক্ষত বেরীতে শুকানো
  • কালচে মলত্যাগ 
  • যন্ত্রণাদায়ক বা লাল প্রস্রাব 
  • ফুসকুড়ি 
  • চুলকানি 
  • কষ্টকর শ্বাসপ্রশ্বাস 
  • কফকাশি 
  • পা, পায়ের গোড়ালি, পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া
  • বুকে ব্যথা
  • চোখ, ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া 

সতর্কতাঃ 

  • চিকিৎসক বা ফার্মাসিস্ট চিকিৎসার শুরুতে রোগীর গৃহীত অন্যান্য ওষুধের সাথে সাইক্লোফসফামাইডের মিথস্ক্রিয়া বিবেচনা করবেন।
  • এই ওষুধ নারীদের মাসিক চক্রে সমস্যা করতে পারে এবং পুরুষের শুক্রাণু উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে। 
  • গর্ভবতী ও শিশুকে স্তনদানকারী নারীরা এই ওষুধ সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসক বা ফার্মাসিস্ট এর সাথে পরামর্শ করবেন।
  • এই ওষুধ গ্রহণ করলে প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করা উচিত।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো খাদ্য সহায়ক, ওষুধ ও ভ্যাক্সিন গ্রহণ করা যাবে না।
  • সাইক্লোফসফামাইড রক্তকণিকার উৎপাদন কমিয়ে দেয় বলে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে এবং এজন্য সংক্রমণ রোধে সাবধান হওয়া আবশ্যক। 

ক্যান্সার বিষয়ক প্রচলিত কিছু জিজ্ঞাসা

”ক্যান্সার, যার নেই কোনো এন্সার” প্রচলিত এই কথাটি কতটুক সঠিক? 

প্রচলিত এই কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়৷ ক্যান্সার মরণব্যাধি হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পড়লে যথাযথ চিকিৎসা নিলে ক্যান্সার সম্পূর্ণরূপে নিরাময় সম্ভব। ক্যান্সারের চিকিৎসা দিন দিন উন্নত হচ্ছে। ক্যান্সার প্রতিরোধে ক্যান্সার সম্পর্কে জানা এবং সচেতন থাকা আবশ্যক৷  তাই ক্যান্সার হলেই মৃত্যু সুনিশ্চিত, কথাটা ঠিক নয়৷ 

ক্যান্সার কি ছোঁয়াচে? 

না, ক্যান্সার মোটেই ছোঁয়াচে রোগ নয়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে এই রোগ অন্যের দেহে ছড়ায় না। তবে কিছু কিছু ক্যান্সার ভাইরাস সংক্রমণের মাধ্যমে হয় বলে শুধুমাত্র সেসব ক্যান্সারকে ছোঁয়াচে বলা যেতে পারে। 

ক্যান্সার আক্রান্ত হবার প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলো ধরা পড়ে না কেন? 

ক্যান্সার অনেক ধরনের হয়ে থাকে। সব ধরনের ক্যান্সার নির্ণয় করার জন্য স্ক্রিনিং টেস্ট নেই। জরায়ু, অন্ত্র, স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়েই স্ক্রিনিং টেস্টে শনাক্ত করা যায়। বাকী ক্যান্সারের ক্ষেত্রে লক্ষণ বোধগম্য হওয়া মাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। 

ক্যান্সার কি বংশগত রোগ? 

ক্যান্সার সৃষ্টিতে জিন এর ভূমিকা আছে। বংশে কারো ক্যান্সার থাকলে অন্যদের ক্যান্সার হবার পরোক্ষ সম্ভাবনা থাকে ঠিকই কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার বা বংশের বাকী সবারও সুনিশ্চিতভাবে ক্যান্সার হবে এমন ধারণা ভুল। 

বাচ্চাদের কি ক্যান্সার হয়? 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর ০-১৯ বছর বয়সী প্রায় ৪ লক্ষ শিশু কিশোর ক্যান্সার আক্রান্ত হয়৷ শৈশব ক্যান্সারের মধ্যে লিউকেমিয়া, ব্রেইন ক্যান্সার, লিম্ফোমা, শক্ত টিউমার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে প্রায় ৮০% ক্যান্সার আক্রান্ত বাচ্চা ই সুস্থ হয় কিন্তু মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে উন্নত চিকিৎসার অভাবে মাত্র ৩০% ক্যান্সার আক্রান্ত বাচ্চা সুস্থ হয়। শৈশব ও কৈশোরকালীন এসব ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে সহজে শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা যায় না। 

সব টিউমারই কি ক্যান্সার? 

সব টিউমারই ক্যান্সার সৃষ্টিকারী নয়৷ টিউমার প্রধানত ২ প্রকার- বিনাইন ও ম্যালিগন্যান্ট। বিনাইন টিউমার কম ছড়ায় এবং পার্শ্ববর্তী কোষ ও টিস্যুকে বেশি আক্রান্ত করে না, তাই এই টিউমার সাধারণত ক্যান্সার তৈরি করে না৷ কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট টিউমার খুব দ্রুত পার্শ্ববর্তী টিস্যুকোষ ও অঙ্গে ছড়ায় বলে এটি ক্যান্সার তৈরি করে। 

ক্যান্সার দিবস কবে? 

প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার দিবস পালিত হয়। একে ক্যান্সার সচেতনতা দিবস ও বলা হয়। ২০০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সামিটে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিনিধি সম্মিলিতভাবে ৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ক্যান্সার দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার প্রতিরোধ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ক্যান্সার রোগীদের জীবনধারার উন্নয়নের লক্ষ্যে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই দিনটি পালন করা হয়। 

বাংলাদেশের কোন কোন হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠান ক্যান্সার গবেষণা ও চিকিৎসা সেবায় কাজ করছে? 

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই ক্যান্সারের চিকিৎসা ও গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৮৬ সালে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার বিশেষায়িত হাসপাতাল ‘জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল’ ঢাকার মহাখালীতে স্থাপিত হয় যা এখন ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট। সাধারণ রোগীদের ৫০% এবং হতদরিদ্র রোগীদের সম্পূর্ণ ওষুধ সরকারীভাবে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৭২ শয্যা বিশিষ্ট ক্যান্সার ইউনিট রয়েছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং দেশের বিভাগীয় শহরের পুরনো মেডিকেল কলেজগুলোতে ক্যান্সারের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে ঢাকায় ডেল্টা মেডিকেল কলেজ, আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি হাসপাতালসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। রাজধানীর বাইরে সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং সিলেটে নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ক্যান্সারে চিকিৎসা দেয়া হয়। 

বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ কেমন? 

বাংলাদেশে একজন ক্যান্সার রোগীর ক্যান্সার চিকিৎসায় বছরে গড়ে প্রায় ৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়। তবে ক্যান্সার ভেদে চিকিৎসা খরচ ভিন্ন হয়। জরায়ুমুখ ক্যান্সারে বছরে গড়ে প্রায় ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। কোলন ক্যান্সারে বছরে গড়ে প্রায় ৮ লক্ষ টাকা খরচ হয়। সব সরকারি হাসপাতালে প্রতিটি রেডিওথেরাপিতে ২৫ হাজার, প্রতিটি কেমোথেরাপিতে ২০ হাজার এবং অস্ত্রোপচারে ৬০ হাজার টাকা করে খরচ হয়। 

বাংলাদেশে ক্যান্সার প্রতিরোধক ওষুধের সহজলভ্যতা কেমন? 

দেড় দশক আগেও বাংলাদেশ এন্টিক্যান্সার ওষুধের জন্য পুরোপুরি আমদানি নির্ভর ছিলো। এসব ওষুধের দামও ছিল খুব বেশি। ২০০৭ সালে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড প্রতিষ্ঠার পর থেকে সর্বপ্রথম ২০০৯ সাল থেকে দেশীয়ভাবে এন্টিক্যান্সার ওষুধের উৎপাদন শুরু হয় যা এখন ১৩৪টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বীকনের তৈরি ওষুধের মান যেমন ভালো, দাম ও কম। ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশীয় ওষুধ কোম্পানি যেমন- এসকেএফ, টেকনো, হেলথকেয়ার, ইনসেপ্টা, রেনাটা, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি এখন দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে অনেক দেশে এন্টিক্যান্সার ওষুধ রপ্তানি করছে। 

তথ্যসূত্রঃ

  • Mathur G, Nain S, Sharma PK. Cancer: an overview. Acad. J. Cancer Res. 2015;8(1).
  • Ferlay J, Ervik M, Lam F, Colombet M, Mery L, Piñeros M, et al. Global Cancer Observatory: Cancer Today. Lyon: International Agency for Research on Cancer; 2020 (https://gco.iarc.fr/today, accessed February 2021).
  • de Martel C, Georges D, Bray F, Ferlay J, Clifford GM. Global burden of cancer attributable to infections in 2018: a worldwide incidence analysis. Lancet Glob Health. 2020;8(2):e180-e190.  
  • Assessing national capacity for the prevention and control of noncommunicable diseases: report of the 2019 global survey. Geneva: World Health Organization; 2020.
  • National Institutes of Health (US); Biological Sciences Curriculum Study. NIH Curriculum Supplement Series [Internet]. Bethesda (MD): National Institutes of Health (US); 2007. Understanding Cancer.
  • Abbas Z, Rehman S. An overview of cancer treatment modalities. Neoplasm. 2018 Sep 19;1:139-57.
  • Clapp RW, Jacobs MM, Loechler EL. Environmental and occupational causes of cancer: new evidence 2005-2007. Reviews on environmental health. 2008 Jan 1;23(1):1-38.
  • Hussain SA, Sullivan R. Cancer control in Bangladesh. Japanese journal of clinical oncology. 2013 Dec 1;43(12):1159-69.
  • National Cancer Institute Website 

আমি মিরাজ আল ফয়সাল। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী প্রফেশনাল মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়নরত আছি। এ বিষয়ে পড়াশোনাকালীন সময় থেকেই বিভিন্ন রোগ, ওষুধের কার্যকারিতা, স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন লেখনী, গবেষণাপত্র, স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক টিপস ইত্যাদি পড়ার ও লেখার আগ্রহ জন্মায়। একজন এ গ্রেড ফার্মাসিস্ট হিসেবে আমি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরীতে এবং স্বাস্থ্যখাতের গবেষণায় কাজ করতে আগ্রহী। 

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.