জন্ডিস/ Jaundice হলো এমন একটি রোগ যেখানে রক্তে অতিরিক্ত বিলিরুবিনের উপস্থিতির কারণে ত্বক, চোখের সাদা অংশ এবং মিউকাস মেমব্রেন হলুদ হয়ে যায়। সাধারণত জন্ডিস তিন ধরনের হয়ে থাকে- প্রি হেপাটিক, হেপাটিক, পোস্ট-হেপাটিক জন্ডিস। লিভার সিরোসিস, ভাইরাল হেপাটাইটিস, অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস, পিত্তথলিতে পাথর, গলব্লাডারে প্রদাহ, ম্যালেরিয়া, সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া ইত্যাদির কারণে জন্ডিস হতে পারে। জন্ডিস হলে সাধারণত চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া, ত্বকে চুলকানি, ক্ষুধা মন্দা, জ্বর ইত্যাদি লক্ষণ গুলো দেখা যায়। এমনকি এটার কারণে শরীরের বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে যেমন- রক্তশূন্যতা, সংক্রমণ, ক্রনিক হেপাটাইটিস, ক্যান্সার, হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি ইত্যাদি।
জন্ডিসের কিছু লক্ষণ পরিলক্ষিত হলেই মূত্র পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষা, ইমেজিং পরীক্ষা এবং এন্ডোসকপির মাধ্যমে বিলিরুবিনের মাত্রা এবং যকৃতের ক্ষতির মাত্রা নির্ণয় করে ফেলুন। যেহেতু জন্ডিস অনেক কারণেই হতে পারে এবং এটি বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, এর চিকিৎসা সম্পূর্ণরূপে অন্তর্নিহিত কারণে উপর নির্ভর করে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন প্রকার ওষুধ গ্রহণ করবেন না। ওষুধ গ্রহণের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করুন যেমন-বেশি বেশি পানি পান করা, তাজা ফল ও শাকসবজি খাওয়া এবং চর্বিহীন প্রোটিন (Lean Protein) সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা।
জন্ডিসের কারণে হতে পারে যকৃতের অকার্যকরিতা, কিডনি ব্যর্থতা, লিভার ক্যান্সার, হেপাটিক এন্সেপালোপ্যাথি, এমনকি মৃত্যুও। সুতরাং জন্ডিস হওয়ার আগে তা প্রতিরোধ করাই উত্তম। প্রতিরোধ করতে হলে সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন গ্রহণ করুন, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন, উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাবার গ্রহণ করুন এবং মদ পান থেকে বিরত থাকুন।
জন্ডিসের কারণসমূহ
জন্ডিস তিন ধরনের হয়ে থাকে- প্রি হেপাটিক (Pre-Hepatic), হেপাটিক (Hepatic) এবং পোস্ট হেপাটিক (Post Hepatic) জন্ডিস।
প্রি-হেপাটিক জন্ডিস নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর কারণে হতে পারে-
১. ম্যালেরিয়া: ম্যালেরিয়া হলো পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রক্তের সংক্রমণ ব্যাধি।
২. সিকেল সেল অ্যানিমিয়া: এটি একটি জেনেটিক রোগ, যেখানে লাল রক্তকণিকা সাধারণ ডিস্কের আকৃতির পরিবর্তে অর্ধচন্দ্রাকার হয়ে যায়।
৩. থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia): এটি একটি জেনেটিক ব্যাধি, যেখানে অনিয়মিত ধরনের হিমোগ্লোবিন তৈরি হওয়ার মাধ্যমে রক্তে সুস্থ লাল রক্ত কণিকার সংখ্যা কমে যায়।
৪. হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া: এ রোগটি হলে রক্ত কোষগুলি তাদের স্বাভাবিক জীবনকাল শেষ হওয়ার আগেই ধ্বংস হয়ে যায়। যার ফলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়।
নিম্নোক্ত কারণে হেপাটিক জন্ডিস হয়-
১. লিভার সিরোসিস: দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ বা বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে থাকার কারণে লিভারের টিস্যুতে দাগ পড়ে, যা লিভার সিরোসিস নামে পরিচিত।
২. ভাইরাল ইনফেকশন যেমন-হেপাটাইটিস এ, বি এবং সি এবং এপস্টাইন-বার ভাইরাসের সংক্রমনের কারণে।
৩. অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস: দীর্ঘদিন মদ পান করার ফলে লিভার টিস্যুতে দাগ পড়ে যায়।
৪. লেপ্টোস্পাইরোসিস: এটি একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ জনিত রোগ, যা সংক্রামিত প্রাণী বা সংক্রামিত প্রাণীর প্রস্রাব বা মল দ্বারা ছড়াতে পারে।
৫. কিছু ওষুধ গ্রহণ করার কারণে যেমন-অ্যাসিটামিনোফেন, পেনিসিলিন, ওরাল গর্ভনিরোধক, ক্লোরপ্রোমাজিন এবং ইস্ট্রোজেনিক বা অ্যানাবলিক স্টেরয়েড ইত্যাদি।
৬. লিভার ক্যান্সার
পোস্ট হেপাটিক জন্ডিস নিম্নোক্ত কারণে হয়-
১. পিত্তথলিতে পাথর
২. গলব্লাডারের প্রদাহ (ফোলা)
৩. গলব্লাডার ক্যান্সার
৪. অগ্ন্যাশয় টিউমার
৫. বিলিয়ারি অ্যাট্রেসিয়া: এটি একটি জেনেটিক রোগ যেখানে পিত্ত নালী সরু বা অনুপস্থিত থাকে।
জন্ডিসের লক্ষণ ও উপসর্গ সমূহ
প্রি হেপাটিক জন্ডিসের লক্ষণ সমূহ-
- পেটে ব্যথা
- জ্বর
- ঠান্ডা লাগা
- অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস
- চুলকানি
- গাঢ় প্রস্রাব বা ফ্যাকাশে মল
হেপাটিক জন্ডিসের লক্ষণ সমূহ-
- ক্ষুধা মন্দা
- রক্তাক্ত নাক
- ত্বকের চুলকানি
- দুর্বলতা
- অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস
- পেট বা পা ফুলে যাওয়া
- গাঢ় প্রস্রাব বা ফ্যাকাশে মল
- পেশী বা জয়েন্টগুলোতে ব্যথা
- ত্বক কালো হওয়া
- জ্বর
পোস্ট হেপাটিক জন্ডিসের লক্ষণ সমূহ-
- অসুস্থ অনুভব হওয়া
- গাঢ় প্রস্রাব বা ফ্যাকাশে মল
- পেটে ব্যথা
- ডায়রিয়া
- অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস
- ত্বকের চুলকানি
- পেট ফুলে যাওয়া
- জ্বর
জন্ডিস শরীরে অনেক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে যেমন-
- ইলেক্ট্রোলাইটের অস্বাভাবিকতা
- রক্তশূন্যতা
- রক্তপাত
- সংক্রমণ/সেপসিস
- ক্রনিক হেপাটাইটিস
- ক্যান্সার
- যকৃতের অকার্যকারিতা
- কিডনি ব্যর্থতা
- হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি (মস্তিষ্কের কর্মহীনতা)
- মৃত্যু
জন্ডিস রোগ নির্ণয়
১. মূত্র পরীক্ষা: এ পরীক্ষার মাধ্যমে মূত্রে বিলিরুবিনের মাত্রা নির্ণয় করা হয়।
২. রক্ত পরীক্ষা: কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (CBC) টেস্ট এবং লিভার ফাংশন টেস্ট এর মাধ্যমে রক্তে বিলিরুবিন ও অন্যান্য পদার্থের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়।
৩. ইমেজিং পরীক্ষা: আল্ট্রাসাউন্ড অথবা এমআরআই পরীক্ষার মাধ্যমে যকৃতের ক্ষতির (Liver damage) মাত্রা ও ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়।
৪. এন্ডোস্কোপি: ক্যান্সার বা অন্যান্য অবস্থা বিশ্লেষণের জন্য এন্ডোসকপির মাধ্যমে যকৃত থেকে টিস্যু নমুনা (Biopsy) নেয়া হয়।
জন্ডিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
জন্ডিসের চিকিৎসা সম্পূর্ণরূপে অন্তর্নিহিত কারণের উপর নির্ভর করে। একবার রোগ নির্ণয় হয়ে গেলে চিকিৎসার উপযুক্ত কোর্স শুরু করা যেতে পারে। কিছু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হবে, যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করানো যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ গ্রহণ করবেন না। চিকিৎসক রোগের অবস্থার উপর ভিত্তি করে আপনাকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি প্রেসক্রাইব করবেন। যেমন-
১. লিভার সিরোসিসের চিকিৎসার জন্য আপনি অ্যালকোহল গ্রহণ বন্ধ করে দিন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিটা ব্লকার এবং ইন্ট্রাভেনাস(IV) অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করুন, যেসব খাবারে প্রোটিন কম আছে সেগুলো গ্রহণ করুন।
২. ভাইরাল হেপাটাইটিসের চিকিৎসার জন্য এন্টিভাইরাল ওষুধ এবং ভ্যাকসিন গ্রহণ করুন, প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিন।
৩. প্রাইমারি বাইলারি সিরোসিসের চিকিৎসার জন্য পিত্ত কমানোর ওষুধ গ্রহণ করুন এবং চুলকানি কমানোর জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন যেমন- ডিফেনহাইড্রামিন গ্রহণ করুন।
৪. অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিসের চিকিৎসার জন্য অ্যালকোহল পান করা থেকে বিরত থাকুন, নিউট্রিয়েন্টস সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন এবং গুরুতর অবস্থায় লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করুন।
৫. লেপ্টোস্পাইরোসিসের চিকিৎসার জন্য সংক্রমণ কমাতে এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করুন, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা সমাধান করতে ভেন্টিলেটর ব্যবহার করুন এবং কিডনি ড্যামেজ হলে ডায়ালাইসিস করুন।
৬. লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কেমোথেরাপি গ্রহণ করুন এবং প্রয়োজন হলে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করুন।
৭. পিত্তথলিতে পাথর হলে এটা রোধ করতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করুন, পাথরটিকে গলাতে ওষুধ গ্রহণ করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পিত্তপাথর অথবা সম্পূর্ণ পিত্তথলি অপারেশনের মাধ্যমে কেটে ফেলুন।
৮. অগ্নাশয় ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ক্যান্সার টিস্যু অথবা সম্পূর্ণ অগ্নাশয় কেটে ফেলুন।
৯. অগ্নাশয়ের প্রদাহের চিকিৎসার জন্য ইন্ট্রাভেনাস তরল গ্রহণ করুন, ব্যথা কমানোর ওষুধ গ্রহণ করুন, পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিন।
১০. বিলিয়ারি অ্যাট্রেসিয়ার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পিত্তনালী অপসারণ ও প্রতিস্থাপনের জন্য কাসাই (Kasai) পদ্ধতি অবলম্বন করুন।
জন্ডিসে আক্রান্ত হলে নিম্নোক্ত খাবার গুলো বেশি বেশি গ্রহণ করুন-
১. পানি: জন্ডিস হলে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। পানি শুধুমাত্র হজমে সাহায্য করে না, বরং এটি লিভার এবং কিডনি থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে।
২. তাজা ফল এবং সবজি: তাজা ফল এবং শাকসবজিতে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার রয়েছে যা বিপাকের সময় লিভারের ক্ষতি কমাতে এবং হজম প্রক্রিয়া সহজ করতে সহায়তা করে। যেমন- ব্লুবেরি, আঙ্গুর, লেবু, জাম্বুরা, পেঁপে, তরমুজ, কুমড়া, মিষ্টি আলু, জলপাই, টমেটো, গাজর, শালগম, ফুলকপি, আদা, পালং শাক ইত্যাদি।
৩. কফি এবং ভেষজ চা: কফি এবং ভেষজ চা তে উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ক্যাফিন রয়েছে, যা লিভারের ক্ষতি কমায় এবং হজমে সাহায্য করে।
৪. গোটা শস্যদানা: পুরো শস্যের খাবারে স্বাস্থ্যকর চর্বি, ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং খনিজ সহ উচ্চ পরিমাণে লিভার-বান্ধব পুষ্টি থাকে।
৫. বাদাম এবং শিম: বেশিরভাগ বাদাম এবং শিম ভিটামিন ই, ফেনোলিক অ্যাসিড এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা যকৃতের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
৬. চর্বিহীন প্রোটিন(Lean Protein): চর্বিহীন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যকৃতের জন্য উপকারী। যেমন-টফু, লেগুম এবং তৈলাক্ত প্রজাতির মাছ। তৈলাক্ত প্রজাতির মাছ, যেমন স্যামন এবং ম্যাকেরেলে ওমেগা -3 ফ্যাটি এসিড/ omega-3 fatty acid এবং জিঙ্ক রয়েছে তা কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিনকে বিপাক করতে সাহায্য করে।
জন্ডিসে আক্রান্ত হলে নিম্নোক্ত খাবার গুলো আহার করা থেকে বিরত থাকুন-
- মদ
- পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট
- প্যাকেটজাত, টিনজাত করা খাবার
- স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাট
- কাঁচা বা কম সিদ্ধ মাছ
- শেলফিশ
- শুয়োরের মাংস
জন্ডিসকে প্রতিরোধ করতে হলে নিম্নোক্ত সতর্কতা গুলো অবলম্বন করুন-
১. হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাকসিন গ্রহণ করুন।
২. মদপান থেকে বিরত থাকুন।
৩. পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।
৪. নিরাপদ পদ্ধতিতে যৌন মিলন করুন কেননা হেপাটাইটিস বি যৌন মিলনের মাধ্যমে ছড়ায়।
৫. উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার যেমন ওটমিল, বেরি এবং বাদাম ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্রহণ করুন।
৫. যে খাবারগুলো জন্ডিসের ঝুঁকি কমায় সেগুলো গ্রহণ করুন।
৬. যে খাবারগুলো জন্ডিসের ঝুঁকি বাড়ায় সেগুলো গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।
৭. প্রতিদিন কমপক্ষে ২.৫ কাপ সবজি এবং ২ কাপ ফল খান।
৮. অস্বাস্থ্যকর খাবার ও দূষিত পানি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।
৯. ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি এমন এলাকায় ভ্রমণ করার সময় ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করতে প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করুন এবং সতর্কতা অবলম্বন করুন।
১০. ধূমপান বন্ধ করুন, কেননা এটি অগ্নাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।