Rheumatoid arthritis

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস

507 বার পড়া হয়েছে

শরীরের রোগ প্রতিরোধতন্ত্র যখন নিজের শরীরকেই ভুলবশত আক্রমণ করে তখন তাকে অটোইমিউন (autoimmune) বা স্বতঃঅনাক্রম্য রোগ বলে। দেহে বিভিন্ন সংক্রমণের পরে রোগ প্রতিরোধে নিয়োজিত কোষগুলো বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং শরীরের টিস্যুতেই আক্রমণ করে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস/ Rheumatoid Arthritis ঠিক সে ধরনের একটি রোগ। যার ফলে অস্থিসন্ধিগুলোতে (কব্জি, হাত ও পায়ের আঙুল, গোঁড়ালি, ঊরু, হাঁটু) প্রদাহ হয়। পরবর্তীতে জটিল আকার ধারণ করে শরীরের অন্যান্য অংশেও (কিডনী, ফুসফুসীয় জটিলতা) ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বাত (ইংরেজি: Arthritis) (গ্রীক arthro - ,সন্ধি + –itis, প্রদাহ) হল মূলত অস্থিসন্ধির প্রদাহ যা এক বা একাধিক অস্থি সন্ধিকে আক্রান্ত করে। এটা শিল্পোন্নত দেশে ৫০-৫৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের মানুষের অক্ষমতা মূল কারণ।

বাত (আর্থ্রাইটিস) কথাটি ব্যাপক অর্থবহ এবং বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। এটি একটিমাত্র রোগ নয় বরং একই পরিবারভুক্ত অনেকগুলো রোগের সমষ্টি। প্রায় ১০০টি বিভিন্ন ধরনের রোগ নিয়ে হয় বাতরোগ। এই রোগে প্রধানত অস্থিসন্ধি আক্রান্ত হলেও হাড়ের প্রদাহ, ক্ষয় রোগ, লিগামেন্ট ও টেন্ডনের ব্যথা, মাংসপেশীর ব্যথা,মেরুদণ্ডের প্রদাহ, ক্ষয়, আড়ষ্ঠতা এগুলোও বাতরোগের পর্যায়ে পরে।

নিম্নোলিখিত রোগগুলোই সাধারণত একত্রিত হয়ে বাতরোগ গঠিত হয়ঃ

সন্ধিবাত/ গাঁট - ফোলানো বাত (Rheumatoid Arthritis)
অষ্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis)/অস্থিসংযোগ গ্রন্থি প্রদাহ
গেঁটে বাত (Gout)
কটিবাত বা কোমর প্রদাহ (Lumbago)
মেরুদণ্ড প্রদাহ বা স্পন্ডিলাইটিস (Spondylitis)
সায়াটিকা/কোটি স্নায়ুশূল(Sciatica)
আম বাত/আর্টিকেরিয়া/অ্যালার্জি(Urticaria)
বাতজ্বর (Rheumatic Fever)
সংক্রামক বাত/সেপটিক আর্থ্রাইটিস
এছাড়াও ঘাড়ের বাত(Stiff Neck), স্কন্ধবাত (Omalgia), পার্শ্ববাত (Pleurodynia) এগুলোও বাত রোগের আওতার মধ্যে পরে।

আর্থ্রাইটিসে যে ধরণের শারীরিক পরিবর্তন ঘটে

রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস অস্থিসন্ধির আবরণ বা লাইনিংকে ধ্বংস করে দেয়। প্রচন্ড ব্যথা হতে হতে জয়েন্টের হাড় ক্ষয়ে গিয়ে টিস্যু অর্থাৎ কোষইকলা ফাইব্রোসিস হয়ে ফুলে ওঠে ও নড়াচড়া করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। অনেকেই রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিসকে বৃদ্ধ বয়সে সৃষ্ট অস্টিওআর্থ্রাইটিস ভেবে থাকেন। কিন্তু সেটি তরুণাস্থি বা কার্টিলেজের ক্ষয়ের কারণে হয়ে থাকে। অস্টিওআর্থ্রাইটিস সাধারণত শরীরের ওজন বহনকারী অস্থিসন্ধিগুলোকে এবং যেসব অস্থিসন্ধি বেশি ব্যবহৃত হয় (যেমন হাঁটু ও হিপ) সেসব অস্থিসন্ধিকে বেশি আক্রান্ত করে।

ধূমপান, শারীরিক ব্যায়ামে অনভ্যাস, স্থূলতা ইত্যদি কারণ আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রায় সব বয়সের মানুষের আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকলেও সাধারণত ৪০-৬০ বছর বয়সী মানুষ এতে বেশি আক্রান্ত হয়। এছাড়াও পুরুষের তুলনায় নারীদের আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ৭৫% আর্থ্রাইটিসের রোগী ৩০-৫০ বছরের মহিলা। শিশু বয়সে সংগঠিত আর্থ্রাইটিসকে জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস বলা হয়। 

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ/ Symptoms of Rheumatoid Arthritis

গিঁট ফুলে যাওয়া, ক্লান্তি, দুর্বলতা, জ্বর, পেশিতে ব্যথা, হাঁটাচলা ও গ্রিপে সমস্যা, সকালে ঘুম থেকে উঠার পর দীর্ঘক্ষণ পেশির জড়তা থাকা ইত্যাদি। 

আর্থ্রাইটিসের ডায়াগনোসিস (শনাক্তকরণ)

সাধারণত এক্সরে, আলট্রাসাউন্ড  ও হেমাটোলজি পরীক্ষার মাধ্যমে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস শনাক্ত করা হয়। এ ধরনের রোগীদের দেহে উচ্চ মাত্রার প্রদাহের জন্য দায়ী বেশ কিছু শনাক্তকারী প্রোটিন ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। 

আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা পদ্ধতি

  • লক্ষণ দূরীকরণ ঔষধ: নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ড্রাগস/ Nonsteroidal anti-inflammatory drug অথবা কর্টিকোস্টেরয়েড। যেমন- এসপিরিন (aspirin), আইবুপ্রোফেন (ibuprofen), এসব ঔষধ গিঁট ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা ও প্রদাহ দূরীকরণে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এরা আর্থ্রাইটিসের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দেয় না। স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দীর্ঘদিন গ্রহণে অস্টিওপরোসিসের (Osteoporosis) সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
  • ইমিউন সাপ্রেসেন্ট ঔষধ (ডিএমআরডি): এরা B-cell ও T-cell ও বিভিন্ন সাইটোকাইন TNF-alpha, IL-1, IL-6 এর উৎপাদন ও নিঃসরণকে প্রতিরোধ করে। এতে করে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রদাহ সৃষ্টিকারী কারণগুলো কমে আসে। উদাহরণ- মিথোট্রেক্সেট (methotrexate), লেফ্লুনোমাইড (leflunomide), হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন (Hydroxychloroquine) ইত্যাদি। পাশাপাশি, সেকেন্ড লাইন অপশন হিসেবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিতে তৈরী মনোক্লোনাল এন্টিবডি যা যেমন- ইনফ্লিক্সিমাব, সেট্রুলিজুমাব, এবাটাসেপ্ট, রিটোক্সিমাব, টসিলিজুমাব ও ব্যবহৃত হয়।
  • শারীরিক ব্যায়াম ও ফিজিওথেরাপি: নির্দিষ্ট পরিসরের শারীরিক ব্যায়াম (হাঁটাচলা, সাঁতার, সাইক্লিং), ইয়োগা ও ফিজিওথেরাপির মাধ্যমেও আর্থ্রাইটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
  • ডায়েট: যেহেতু স্থূলতা আর্থ্রাইটিসের অন্যতম একটি রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে যেহেতু সুষম খাদ্য পরিমিত পরিমানে গ্রহণ করলে আর্থ্রাইটিস সৃষ্টির সম্ভাবনা কমে আসে। ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, আয়রন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার আর্থ্রাইটিস রোগীদের ক্ষেত্রে প্রদাহের মাত্রা অনেকাংশেই কমায়। অপরপক্ষে উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত, উচ্চ শর্করা প লবণযুক্ত খাবার প্রদাহের মাত্রা ও ঝুঁকি বাড়ায়।
  • উপরের ব্যবস্থাগুলোতেও যদি আর্থ্রাইটিসের সমাধান না হয়, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ আর্থোস্কোপি বা জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে জয়েন্টের প্রদাহসৃষ্টিকারী টিস্যুকে সরিয়ে ফেলা হয়।

গর্ভাবস্থায় আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি

  • ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ঔষুধ মিথোট্রেক্সেট ও লেফ্লুনোমাইড গর্ভবতীদের জন্য উপযুক্ত নয়।  কারণ এগুলো মাতৃদেহে ফলিক এসিডের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে গর্ভপাত ও ফিটাসের জেনেটিক বৈকল্য সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন একটি উপযুক্ত ঔষুধ। সেই সাথে গর্ভবতী নারীদের অবশ্যই ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট দিতে হয়।

আরও পড়ুন

  • Khoury V, Kourilovitch M, Massardo L. Education for patients with rheumatoid arthritis in Latin America and the Caribbean. Clinical Rheumatology. 2015 Mar;34(1):45-9.
  • Eating Well with Arthritis. Versus Arthritis. (Cited on February 12, 2022). Available from https://www.versusarthritis.org/about-arthritis/managing-symptoms/diet/
  • Walker R, Whittlesea C. Clinical Pharmacy and Therapeutics. 5th edition. London. Elsevier. 2012.

আমি সৈয়দ মুমতাহিন মান্নান সিয়াম। পড়াশোনা করছি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের স্নাতক সম্মান শেষ বর্ষে। পড়াশোনার পাশাপাশি বিতর্ক, লেখালেখি, খেলাধুলা ও বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত রয়েছি। দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার, গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখি।

1 Comment

  1. […] রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস/ Rheumatoid Arthritis হলো এমন একটি প্রদাহজনিত অটোইমিউন (autoimmune) রোগ, হাতের ও পায়ের আঙুলের অস্থিসন্ধিতে ব্যথা দিয়ে রোগের সূত্রপাত হয়ে রোগীদের হাঁটু, গোড়ালি, শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট গুলোতে ব্যথা অনুভূত হয়, জয়েন্ট ফুলে যায় এবং পেশি শক্ত হয়ে যায়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে রোগীর দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা‌ দেহের সুস্থ কোষকে আক্রমণ করে প্রদাহের সৃষ্টি করে। প্রাথমিক‌ ধাপে চিকিৎসা না করালে এটি দেহের একটি নির্দিষ্ট অঙ্গে সীমাবদ্ধ না থেকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমনকি চোখ, ফুসফুসের মতো অন্যান্য অঙ্গকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিলেই একজন ভালো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরী এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। […]

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.