গর্ভকালীন ডায়াবেটিস — সচেতনতায় হোক নিরাপদ মাতৃত্ব
//

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস — সচেতনতায় হোক নিরাপদ মাতৃত্ব

204 বার পড়া হয়েছে

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কি?

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলিটাস (Gestational Diabetes Mellitus/জিডিএম) হল গর্ভাবস্থার একটি জটিলতা, যেখানে গর্ভাবস্থায় রক্তে শর্করার/ গ্লুকোজের হার বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় শরীরের চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত ইনসুলিন(অগ্নাশয় এর প্রধান হরমোন, এক ধরনের পলিপেপটাইড যা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে) তৈরি করতে না পারায় রক্তে শর্করার পরিমাণ সাধারণ মাত্রা থেকে বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায়, হাইপারইনসুলিনেমিয়া এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সসহ একাধিক হরমোনাল পরিবর্তন হয়। অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষের কর্মহীনতার কারণে শর্করার ভারসাম্যহীনতার ফলাফল হল এই হাইপারগ্লাইসেমিয়া। গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতার  মধ্যে, গর্ভবতী মায়েদের হাইপারগ্লাইসেমিয়াসহ ডায়াবেটিস সম্পর্কিত ঝুঁকি থাকে যা একজনের পরিবর্তে দুইজন ব্যক্তি- মা ও তার অনাগত শিশুর জন্য সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা করে থাকে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তে শর্করার দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং সাধারণত প্রসবের পরে চলে যায়, তবে এই অবস্থার সাথে যুক্ত মহিলাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। ক্রমশ গর্ভকালীন এই জটিলতা বেড়েই চলেছে। 

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রাদুর্ভাব

জিডিএমের ইতিহাস ১৯৬৪ সাল থেকে শুরু হয়েছিল তখন গর্ভাবস্থায় গ্লুকোজ সহনশীলতার মাত্রা ব্যাখ্যা করার জন্য নির্দিষ্ট মানদন্ড প্রস্তাব করা হয়, যাতে প্রসবের পরে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মহিলাদের শনাক্ত করা যায়। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ২০১৭ অনুসারে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১৪ শতাংশ গর্ভধারণ কে প্রভাবিত করে, যা বছরে প্রায় ১৮ মিলিয়ন জন্ম ধারণে প্রভাব ফেলে এবং এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান স্থূলতা মহামারীর সাথে বৃদ্ধি পেতে চলেছে।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ছিল ২৪.২ শতাংশ যা জিডিএম এর সর্বোচ্চ প্রকোপ। যেখানে আফ্রিকায় সর্বনিম্ন প্রকোপ ১০.৫ শতাংশ দেখা গেছে। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন অনুমান করেছে যে, ১৬ শতাংশ শিশু গর্ভাবস্থায় থেকে আক্রান্ত এবং এদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ জিডিএমের ফলাফল। গর্ভাবস্থায় হাইপারগ্লাইসেমিয়ার প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ গুলিতে ঘটেছে যেখানে মাতৃস্বাস্থ্য পরিসেবা সীমিত। এমনকি দেশের অভ্যন্তরে জিডিএম পরিবর্তিত হয় জাতিগত এবং আর্থসামাজিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান, মধ্যপ্রাচ্যের  অধিবাসী এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের বসবাসকারী গোষ্ঠী জিডিএমের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্থানীয় আমেরিকান, এশিয়ান এবং আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলার চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ককেশীয় নারী। এছাড়াও কিছু প্রমাণ রয়েছে যে, ঋতু অনুসারে এর প্রকোপ পরিবর্তন হতে পারে।

বিশ্বব্যাপী গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এর প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব দিন দিন বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি গবেষণায় জানা গেছে, জিডিএম এর প্রাদুর্ভাব ছিল ৬ শতাংশ এবং ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে জি ডি এম আক্রান্ত মায়ের মধ্যে গর্ভপাত, নবজাতকের মৃত্যু এবং মৃত জন্মের উচ্চহার আরো স্পষ্ট হয়েছে। মায়েরা ও তাদের শিশুরা ভবিষ্যতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। 

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয়:

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন আনুষ্ঠানিকভাবে জিডিএমকে গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় বা তৃতীয়   ত্রৈমাসিকে প্রথম নির্ণয় করা ডায়াবেটিস হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করে যা স্পষ্টভাবে আগে থেকে বিদ্যমান টাইপ ওয়ান বা টাইপ টু ডায়াবেটিস নয়। 

ডায়াবেটিস পরীক্ষা জন্য উপবাস অবস্থায়, ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ ও পানি খাওয়ার দু’ঘণ্টা আগে এবং পরের গ্লুকোজের মাত্রা নির্ণয় করতে হয়।

পরীক্ষার সময়গ্লুকোজ/শর্করার মাত্রা
উপবাস প্লাজমা গ্লুকোজ৯২-১২৫মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার
১ ঘন্টা পর প্রানডিয়াল গ্লুকোজ১৮০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার
২ ঘন্টা পর প্রানডিয়াল গ্লুকোজ১৫৩মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার
সারণী-১ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মেলিটাস নির্ণয়ের মানদন্ড(ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট-ওজিটিটি)

ঝুঁকির কারণ:  

১. বয়স: বয়স বৃদ্ধির সাথে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়; ২৫ বছরের কম বয়সি, কম ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত।

২. জাতিসত্তা:

  • সর্বোচ্চ ঝুঁকি: নেটিভ আমেরিকান, হিস্পানিক, এশিয়ান।
  •  মাঝারি ঝুঁকি: আফ্রিকান মহিলা
  •  সর্বনিম্ন ঝুঁকি: অ-হিস্পানিক সাদা মহিলা

৩. স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা অধিক ক্যালরি গ্রহণের সাথে অভ্যন্তরীণভাবে যুক্ত, যা বিটা কোষের ইনসুলিন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়।

৪. পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের মা-বাবার ডায়াবেটিস থাকলে।

৫. অতীত প্রসূতি ইতিহাস:  

  • যে মহিলারা আগে একটি বড়(ওজন ৯ পাউন্ডের বেশি) শিশুর জন্ম দিয়েছেন, 
  • পূর্ববর্তী জিডিএম এর ইতিহাস  থাকলে,
  • পূর্বে গর্ভপাত হয়ে থাকলে।
  • অন্যান্য রোগ থাকলে; যেমন, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম।

৬. জীবনযাত্রা: ব্যায়ামের অভাব, মানসিক চাপ থেকেও প্রভাব পড়ে। বডি মাস ইন্ডেক্স এবং সামগ্রিক ক্যালরি গ্রহণ খাদ্য ও পুষ্টি এর সাথে যুক্ত। যেসব খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, রিফাইন্ড শর্করা, লাল ও প্রক্রিয়াজাত মাংস বেশি থাকে সেগুলো জিডিএমের সাথে ধারাবাহিকভাবে যুক্ত থাকে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্যাথোফিজিওলজি:

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের সাথে যুক্ত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, 

  • প্রথমত- বিটা কোষের কর্মহীনতা। 

বিটা কোষের প্রাথমিক কাজ হল শরীরে গ্লুকোজ এর ভারসাম্য রক্ষার্থে ইনসুলিন সঞ্চয় করা এবং  নিঃসরণ করা। যখন বিটা কোষ পর্যাপ্তভাবে রক্তে গ্লুকোজের ঘনত্ব অনুধাবন করার ক্ষমতা হারায়  বা প্রতিক্রিয়া হিসেবে পর্যাপ্ত ইনসুলিন নিঃসরণ করেনা, তখন এটিকে বিটা কোষের কর্মহীনতা বলা হয়। একবার বিটা কোষের কর্মহীনতা শুরু হলে হাইপারগ্লাইসেমিয়া ইনসুলিনের অকার্যকারিতা চক্রাকারে চলতে থাকে।  প্রকৃতপক্ষে, বিটা কোষের কর্মহীনতার অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া বিভিন্ন রকম ও জটিল হতে পারে। প্রক্রিয়ার যে কোন পর্যায়ে ত্রুটি দেখা দিতে পারে:  প্রো-ইনসুলিন সংশ্লেষণ, পোস্ট ট্রানসলেশন পরিবর্তন, রক্তে গ্লুকোজের ঘনত্বের সংবেদন ইত্যাদি। 

  • দ্বিতীয়ত-  দীর্ঘস্থায়ী ইনসুলিন প্রতিরোধ

যখন কোষগুলি ইনসুলিনের জন্য পর্যাপ্তভাবে সাড়া দেয় না তখন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ঘটে.  ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সাধারণত ইনসুলিন সিগন্যালের ব্যর্থতা, যার ফলে গ্লুকোজ ট্রান্সপোর্টার-৪(প্রাথমিক ট্রান্সপোর্টার যা কোষের ভেতর গ্লুকোজ আনার জন্য দায়ী)-এর অপর্যাপ্ত প্লাজমা মেমব্রেন ট্রানসলোকেশন হয়। 

যদিও জিডিএমের প্রকৃত কারণ পরিচিত নয়, কিছু শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া এর সাথে সম্পর্কিত।

স্বাভাবিক গর্ভাবস্থায় মায়ের  টিস্যুগুলি ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠে। প্লাসেন্টা থেকে প্রাপ্ত হরমোনের কারণে এবং আংশিকভাবে অন্যান্য স্থূলতা, গর্ভাবস্থায় সাথে সম্পর্কিত কারণে যা সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায়না বলে মনে করা হয়। স্বাভাবিক গর্ভাবস্থায় ইনসুলিনের মধ্যস্থতায় পুরো শরীরে গ্লুকোজ নিষ্পত্তি ৫০ শতাংশ কমে যায় এবং একটি  ভারসাম্যতা বজায় রাখার জন্য গর্ভবতী নারীকে অবশ্যই তার ইনসুলিন নিঃসরণ ২০০ থেকে ২৫০  শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে।  যখন গর্ভবতী মহিলা স্বাভাবিক ইনসুলিন প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে সক্ষম হয় না তখনই    জিডিএম বিকশিত হয়। গ্লুকোজ প্লাসেন্টার মাধ্যমে ভ্রুণে স্থানান্তরিত হয়। মাতৃ হাইপারগ্লাইসেমিয়া অতিরিক্ত প্লাসেন্টাল গ্লুকোজ স্থানান্তর প্রতিরোধ করতে ভ্রূণের হাইপেরিনসুলিনেমিয়া কে উদ্দীপিত করে, যার ফলে ম্যাক্রোসোমিয়া হয় (ওজন ৪০০০ গ্রামের বেশি)।

প্লাসেন্টা পুষ্টি এবং জল একটি ক্রমবর্ধমান ভ্রূণকে সরবরাহ করে এবং গর্ভাবস্থা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন ধরণের হরমোনও তৈরি করে। এর মধ্যে কিছু হরমোন (এস্ট্রোজেন, কর্টিসল এবং মানব প্লাসেন্টাল ল্যাকটোজেন) ইনসুলিনের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। একে contra-insulin effect বলা হয়, যা সাধারণত গর্ভধারণের প্রায় ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহ পরে শুরু হয়। 

প্লাসেন্টা বাড়ার সাথে সাথে এই হরমোনগুলির আরও বেশি উৎপাদিত হয় এবং ইনসুলিন প্রতিরোধের ঝুঁকি আরও বেশি হয়ে যায়। সাধারণত, অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সকে  প্রতিরোধ করার জন্য অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি করতে সক্ষম হয়, কিন্তু যখন ইনসুলিনের  উৎপাদন প্লাসেন্টাল হরমোনের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট হয় না, তখন ফলাফল গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। 

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণ

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সাধারণত কোন বিশেষ লক্ষণ দেখা যায় না।  

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভকালীন চেকআপের সময় এটি ধরা পড়ে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা অনেকখানি বেড়ে গেলে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন:

  • পর্যাপ্ত জল পান করলেও ঘন ঘন পিপাসা লাগা,
  • আগের তুলনায় ঘনঘন প্রস্রাবের বেগ আসা,
  • মুখ, জীভ শুকিয়ে যাওয়া,
  • গর্ভাবস্থায় ক্লান্তি স্বাভাবিক হলেও কিছুটা বেশি ক্লান্তি বোধ করা,
  • প্রথম ত্রৈমাসিকে অধিক বমি বমি ভাব 

যদিও লক্ষণগুলো দেখা দেওয়া মানেই যে আপনার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়েছে, তা নয়। কিছু লক্ষণ  গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকভাবে দেখা যেতে পারে।

গর্ভবতী মায়ের জটিলতা: 

১. মাতৃত্বকালীন জটিলতার ঝুঁকি বৃদ্ধি: গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস আক্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির অবনতি হতে পারে, কিটোএসিডোসিস বাড়তে পারে এমন ঝুঁকি রয়েছে।

২. প্রসূতি জটিলতার বর্ধিত ঝুঁকি: গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ,গর্ভকালীন খিঁচুনি, সিজারিয়ান সেকশন, ম্যাক্রোসোমিয়ার কারণে ব্র্যাডিটোসিয়া এবং প্রস্রাবের প্রবণতা বৃদ্ধির ঘটনা।

৩. পেরিনেটাল জটিলতার ঝুঁকি: ম্যাক্রোসোমিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি, অন্তঃসত্ত্বা ভ্রূণের বিকাশে বিলম্ব, নবজাতকের জটিলতা( হাইপারগ্লাইসেমিয়া, পলিসাইথেমিয়া, হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া ইত্যাদি)।

৪. গর্ভপাত: গর্ভপাত, পরবর্তী গর্ভাবস্থায় গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের উচ্চ ঝুঁকির সাথে যুক্ত। গবেষকরা নির্ধারণ করেছেন যে যে মহিলাদের পূর্বে গর্ভপাত হয়েছিল, তাদের পরবর্তী গর্ভাবস্থায় গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২৫ শতাংশ বেশি ছিল। তারা আরও দেখেছেন যে গর্ভপাতের সংখ্যা যত বেশি হবে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তত বেশি হবে। 

৫. ভবিষ্যতে মায়ের টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

৬. জিডিএমসহ মায়েদের সন্তানদের মধ্যে জীবনধারা সম্পর্কিত রোগের বিকাশ ঘটে।

৭. জিডিএম বিপাকীয় সিন্ড্রোম এবং কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (সিভিডি) ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিপাকীয় সিন্ড্রোম কেন্দ্রীয় স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ইনসুলিন প্রতিরোধের এবং ডিসলিপিডেমিয়াসহ বেশ কয়েকটি ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 

শিশুর জন্য সম্ভাব্য জটিলতা: 

সাধারণভাবে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের দুটি প্রধান সমস্যা রয়েছে: ম্যাক্রোসোমিয়া এবং হাইপোগ্লাইসেমিয়া।

১. ম্যাক্রোসোমিয়া

ম্যাক্রোসোমিয়া এমন একটি শিশুকে বোঝায় যে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড়। ভ্রূণ যে সমস্ত পুষ্টি গ্রহণ করে তা সরাসরি মায়ের রক্ত থেকে আসে। যদি মাতৃত্বকালীন রক্তে খুব বেশি গ্লুকোজ থাকে তবে ভ্রূণের অগ্ন্যাশয় উচ্চ গ্লুকোজের মাত্রা অনুভব করে এবং এই গ্লুকোজটি ব্যবহার করার প্রচেষ্টায় আরও ইনসুলিন তৈরি করে। ভ্রূণ অতিরিক্ত গ্লুকোজকে চর্বিতে রূপান্তরিত করে। এমনকি মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলেও, ভ্রূণটি তার প্রয়োজনীয় সমস্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। মায়ের কাছ থেকে উচ্চ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা এবং ভ্রূণের উচ্চ ইনসুলিনের মাত্রাগুলির সংমিশ্রণের ফলে প্রচুর পরিমাণে চর্বি জমা হয় যা ভ্রূণকে অত্যধিক বড় করে তোলে।

২. হাইপোগ্লাইসেমিয়া

হাইপোগ্লাইসেমিয়া প্রসবের পরপরই শিশুর রক্তে শর্করার পরিমাণ কম হওয়াকে বোঝায়। এই সমস্যাটি ঘটে যদি মায়ের রক্তে শর্করার মাত্রা ধারাবাহিকভাবে বেশি থাকে, যার ফলে ভ্রূণের প্রচলনে উচ্চ মাত্রার ইনসুলিন থাকে। প্রসবের পরে, শিশুর ইনসুলিনের মাত্রা বেশি থাকে, তবে তার মায়ের কাছ থেকে আর উচ্চ মাত্রায় চিনি থাকে না, যার ফলে নবজাতকের রক্তে শর্করার মাত্রা খুব কম হয়ে যায়। জন্মের পরে শিশুর রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা হয় এবং যদি মাত্রা খুব কম হয় তবে শিশুকে অন্ত্রে গ্লুকোজ দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। 

৩. জন্মের পরেই শিশুর জন্ডিস হতে পারে।

৪. জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটি হতে পারে।

৫. শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা হয়ে থাকে

৬. জন্মের পরও শিশু মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি থাকে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা 

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয় নিশ্চিত হয়ে গেলে প্রাথমিক ব্যবস্থাপনায় ডায়েটারি কাউন্সিলিং, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এবং রক্তের গ্রুপ মনিটরিং জড়িত। আমেরিকান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখা, ভ্রূণের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং উপযুক্ত ওজন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য একজন নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান দ্বারা কাউন্সেলিং করানোর সুপারিশ করেন। প্রতিদিন চারবার গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণের সুপারিশ করা হয়। 

বিশেষ করে একটি জনসংখ্যা যেমন, বাংলাদেশে যেখানে ডায়াবেটিস এর প্রাদুর্ভাব উচ্চ এবং ৫০ শতাংশের বেশি আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোগ নির্ণয় থেকে দূরে থাকে; আদর্শ ভাবে সব গর্ভবতী মহিলাদের তাদের প্রথম ত্রৈমাসিকে পরীক্ষা করা উচিত।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা প্রধান শর্ত হলো, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম করা। রোগীর বয়স, সামগ্রিক স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ইতিহাস, প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে জীবনযাত্রার পরিবর্তনের পাশাপাশি ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।

আমেরিকান ডায়াবেটিকস অ্যাসোসিয়েশন, সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন অফ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি চিকিৎসার জন্য ইনসুলিন এর সুপারিশ করে। অন্যদিকে,ওরাল এন্টি-ডায়াবেটিক এজেন্ট মেটফরমিন, গ্লাইবুরাইড উভয়ই প্লাসেন্টা অতিক্রম করে, পরীক্ষায় এমন তথ্য পাওয়ার কারণে প্রথম লাইন এজেন্ট হিসেবে এদের ব্যবহার করা হত না। পূর্বের ক্লিনিক্যাল নির্দেশিকায় ওরাল অ্যান্টি ডায়াবেটিক এজেন্ট গুলোকে ব্যবহারের সুপারিশ করা হতো না কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় ওষুধ গুলোর নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা প্রমাণ সাপেক্ষে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস চিকিৎসার ইনসুলিনের বিকল্প থেরাপি হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান রয়েছে। 

ওষুধের জেনেরিক নামপরিচিতিসাধারণ ডোজ/ মাত্রাব্র্যান্ড/ প্রচলিত নাম
ইনসুলিন (Insulin)উৎপাদিত  হরমোন যা রক্তে শর্করার ভারসাম্য রক্ষা করে। ০.৭-২ ইউনিট/কেজিগ্লাইসেট মিক্স (ইনসুলিন এসপার্ট),
ইনসুল লিসপ্রো ১০০-আই ইউ/ মিলি,
হিউমুলিন এন ১০০-আই ইউ/ মিলি (এনপিএইচ ইনসুলিন),
হিউমুলিন আর১০০-আই ইউ/ মিলি (রেগুলার ইন্সুলিন),
লেভেমির১০০-আই ইউ/ মিলি(ইনসুলিন ডেটেমির)
মেটফরমিন (Metformin)ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিকারী,মৌখিক এন্টি-ডায়াবেটিক এজেন্ট।৫০০মি.গ্রা. নোবেসিট ৫০০ মি.গ্রা.
ইনফরমেট ৫০০মি.গ্রা.
সুগামেট ৫০০মি.গ্রা.
ভিটমেট৫০০মি.গ্রা. 
গ্লাইমিন৫০০মি.গ্রা.
সারণী-২  গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের জন্য বাংলাদেশের প্রচলিত ঔষধসমূহ

ইনসুলিন

ইনসুলিন হল গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এর চিকিৎসার জন্য প্রথম সারির থেরাপি। 

হিউম্যান ইনসুলিন হল ইনসুলিনের একটি রিকম্বিনেন্ট ফর্ম। ইনসুলিন থেরাপি নিরাপদ  ও কার্যকর এবং এটিকে আদর্শ মান হিসেবে অন্যান্য থেরাপি সাথে তুলনা করা হয়। রেগুলার এবং এন পি এইচ ইনসুলিন এবং লং অ্যাক্টিং ইনসুলিন এনালগ  লিসপ্রো এবং অ্যাসপার্ট নিরাপদ বলে মনে করা হয়। ৮০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক জিডিএম চিকিৎসার জন্য ইনসুলিন ব্যবহার করেন। আমেরিকান কলেজ অবস্টেট্রিশিয়ানস এন্ড গাইনোকোলজিস্ট বলে যে, ইনসুলিনকে এর প্রমাণিত নিরাপত্তার কারণে প্রথম সারির এজেন্ট হিসেবে আগে থেকে নেওয়া হয়।  এটি তার আণবিক আকারের কারণে প্লাসেন্টা অতিক্রম করে না।

নামপ্রকার  অনসেট (Onset)সর্বোচ্চ প্রভাবসময়কাল
(Duration)
প্রস্তাবিত ডোজ/ মাত্রা ব্যবধান
এসপার্ট (Aspart)রেপিড-অ্যাক্টিং১৫মিনিট৬০ মিনিট২ ঘন্টাপ্রতিবার খাওয়ার শুরুতে 
লিসপ্রো (Lispro) রেপিড-অ্যাক্টিং১৫ মিনিট৬০ মিনিট২ ঘন্টাপ্রতিবার খাওয়ার শুরুতে
রেগুলার ইনসুলিন (Regular Insulin)ইন্টারমিডিয়ট অ্যাক্টিং৬০মিনিট২-৪ ঘন্টা৬ ঘন্টা৬০-৯০ মি. খাওয়ার আগে
এনপিএইচ (NPH)ইন্টারমিডিয়ট অ্যাক্টিং২ ঘন্টা৪-৬ ঘন্টা৮ ঘন্টাপ্রতি ৮ ঘন্টা
ডেটেমির (Detemir)লং-অ্যাক্টিং২ ঘন্টা১২ ঘন্টাপ্রতি ১২ ঘন্টা
সারণী-৩ গর্ভাবস্থায় নিরাপদ ইনসুলিনের প্রকার
  • ইনসুলিনের প্রাথমিক ডোজ হল ০.৭ থেকে ১.০ ইউনিট/কেজি।
  • ইনসুলিনের প্রাথমিক ডোজ নির্দেশিকা: 

ডোজ ও ইনসুলিনের ধরনের নির্ভর করে ওজন, গর্ভকালীন সময়, ডায়েট এবং গ্লুকোজ প্রোফাইলের উপর।

সপ্তাহের গর্ভাবস্থাদৈনিক ইনসুলিন ডোজ (ওজন/কেজি)
১-১৩০.৭
১৪-২৬০.৮
২৭-৩৭০.৯
৩৮ থেকে প্রসব সময়১.০
প্রসবোত্তর০.৫৫
সারণি-৪ গর্ভকালীন সময় অনুযায়ী ইনসুলিন ডোজ

যেকোনো ধরনের ডায়াবেটিসসহ গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থেরাপির সূচনা বিন্দু হল মেডিকেল নিউট্রিশন থেরাপি (খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম)। তবে, ডায়াবেটিস গর্ভাবস্থায় দ্রুত নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। তাই এমএনটি ট্রায়াল’ এক সপ্তাহ বা তার কম সময়ের মধ্যে গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে ব্যর্থ হলে ডায়াবেটিস থেরাপি বাড়াতে হবে। উচ্চমাত্রার  হাইপারগ্লাইসেমিয়াসহ মহিলাদের এমএনটি তে সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা কম, তাই ফার্মাকোলজিক্যাল চিকিৎসা অবিলম্বে শুরু করা হয়।

 ইনসুলিন নির্দেশনা

  • ইনসুলিন থেরাপি শুরু হয় যখন ক্যাপিলারি ব্লাড গ্লুকোজের মাত্রা উপবাস অবস্থায় ১০৫ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার(৫.৮মিলিমোল/লিটার) এবং খাবারের দুই ঘন্টা পরে ১২০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার(৬.৭ মিলিমোল/লিটার) এর বেশি হয়ে যায়।
  • ইনসুলিন এর ধরন এবং সময় নির্ভর করে রক্তে গ্লুকোজ লেভেল এর উপর।

যদি উপবাস অবস্থায় গ্লুকোজ লেভেল ১০৫ মিলিগ্রাম/ ডেসিলিটার এর বেশি হয়-বেসাল ইনসুলিন শোবার আগে দেওয়া হয়, রেপিড অ্যাক্টিং ইনসুলিন এনালগ বা নিরপেক্ষ প্রোটামিন হ্যাজের্ডান(এনপিএইচ) ইনসুলিনও খাওয়ার আগে দেওয়া যেতে পারে।

  • যদি খাওয়ার পরেও শর্করার মাত্রা বেশি থাকে, ৬ থেকে ১০ ইউনিট রেপিড-অ্যাক্টিং ইনসুলিন(লিসপ্রো বা অ্যাসপার্ট) খাবারের আগে দিতে হবে।
  • খাবারের আগে এবং পরে রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। যদি উভয় অবস্থাতেই রক্তে শর্করার ঘনত্ব বেশি হয় সে ক্ষেত্রে দিনপ্রতি চারবার ইনজেকশন নিতে হবে।
  • লং অ্যাক্টিং ইন্সুলিন(ইনসুলিন ডেটেমির) এনালগের ক্ষেত্রে দিনে দুইবার দেওয়া যেতে পারে।
  • গর্ভবতী মহিলাদের পেটে  বা উরুর পাশের চর্বিযুক্ত জায়গায় ইনসুলিন দেওয়া উচিত। 
  • সাধারণত ত্বকের নিচে ইনসুলিন ইনজেকশন দিতে হয়।

থেরাপির লক্ষ্য: খাবারের আগে ৬৫ থেকে ৯০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এবং খাবারের পরে <১২০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার রক্তে শর্করার মাত্রা আনতে হবে।

ইনসুলিন থেরাপির কার্যপ্রক্রিয়া

ইনসুলিন কোষের প্লাজমা ঝিল্লিতে তার রিসেপ্টরের সাথে সরাসরি আবদ্ধ হয়ে কাজ করে।এই রিসেপ্টর গুলো সমস্ত কোষে উপস্থিত থাকে, তবে তাদের ঘনত্ব কোষের ধরনের ওপর নির্ভর করে। সর্বাধিক ঘনত্ব হেপাটিক কোষ এবং অ্যাডিপোসাইটগুলোতে থাকে। ইনসুলিন রিসেপ্টর হলো গ্লাইকোপ্রোটিন, এর দুটি সাব ইউনিট আলফা ও  বিটা। আলফা সাব ইউনিটে ইনসুলিন বাইন্ডিং সাইট রয়েছে। যখন ইনসুলিন  আলফা সাব ইউনিটের সাথে আবদ্ধ হয় তখন এটি বিটা সাবইউনিটে  টাইরোসিন কাইনেজকে সক্রিয় করে কোষে গ্লুকোজ পরিবহনকারীদের স্থানান্তর ঘটায়। এ গ্লুকোজ পরিবহনকারীরা রক্ত থেকে  কোষে গ্লুকোজ প্রবাহের অনুমতি দেয় এভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা হ্রাস করে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে অগ্নাশয় ইনসুলিন তৈরি করতে অতিরিক্ত কাজ করতে হয় কিন্তু ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায় না। যদিও গ্লুকোজ ও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান গুলোর মত ইনসুলিন প্লাসেন্টা অতিক্রম করে না, তাই অতিরিক্ত রক্তের গ্লুকোজ প্লাসেন্টার মধ্য দিয়ে যায় যা শিশুর রক্তে গ্লুকোজের উচ্চমাত্রা দেয়; এর ফলে শিশুর অগ্নাশয় রক্তের গ্লুকোজ থেকে মুক্তি পেতে অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি করে। যেহেতু শিশুটি বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শক্তি পাচ্ছে তাই অতিরিক্ত শক্তি চর্বি হিসেবে জমা হয়। ফলশ্রুতিতে শিশুর দেহে জটিলতা দেখাবে। যখন ইনসুলিন থেরাপির মাধ্যমে বাইরে থেকে নেওয়া হয়, এটি মায়ের শরীরের অতিরিক্ত গ্লুকোজ কে প্রশমিত করে এবং গ্লুকোজ প্লাসেন্টার অতিক্রম করে শিশুর শরীরে পৌছাতে পারেনা। যার ফলে, গর্ভবতী মায়ের শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা সাধারণ থাকে। 

ইনসুলিন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া 

  • শরীরে সঠিকভাবে না থাকলে রক্তে ইনসুলিন কম শর্করা কারণ হতে পারে, যাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয়। রোগী যদি খাবার এড়িয়ে যায় এবং খুব বেশি ইনসুলিন ব্যবহার  করে, তবে এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সংকেত হিসেবে দেখা হতে পারে- মাথা ঘোরা, ঘাম,কাঁপুনি এবং ঝাপসা দৃষ্টি।
  • এছাড়াও শরীরের একই স্থানে ইনজেকশন নিতে থাকলে ওই স্থানে কিছুটা অস্বস্তি, ব্যথা হতে পারে। 

ইনসুলিন প্রতিনির্দেশনা

ইনসুলিনের ধরন, ডোজ সামঞ্জস্য ও নিরীক্ষণ করে ব্যবহার করা হলে, গর্ভবতী মহিলাদের ইনসুলিন থেরাপির জন্য তেমন কোনো প্রতিনির্দেশনা নেই।

ইনসুলিন ব্যবহারে সতর্কতা

ডোজ সমন্বয় ও পর্যবেক্ষণ- ইনসুলিন ব্যবহার করা গর্ভবতী রোগীদের নিয়মিত রক্তের শর্করা নিরীক্ষণ করা উচিত যাতে শর্করার মাত্রা কমে গিয়ে জটিলতা দেখা না দিতে পারে। সতর্কতার সাথে এবং বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে নিয়ম মেনে চলতে হবে। 

মেটফরমিন 

এটি বাইগুয়ানাইড শ্রেণীর ওরাল অ্যান্টি-হাইপারগ্লাইসেমিক এজেন্ট।

মেটফরমিন একটি ঔষধ যা রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গবেষণায় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মেলিটাস চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে মেটফর্মিন নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে।

যদিও ইনসুলিন হল গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের আদর্শ ঔষধ, পাশাপাশি এর সহজলভ্যতা, স্বল্প দাম, রোগীর ইনজেকশন ভীতি প্রভৃতি কারণে মেটফরমিন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে এবং সর্বোপরি, এর মাধ্যমে মা ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ইনসুলিনের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে সুপারিশ করা হয়ে থাকে। মেটফর্মিন যুক্তিসঙ্গতভাবে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য সুপারিশ করা যেতে পারে যাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মেলিটাসের ইতিহাস রয়েছে, খুব স্থূল, যাদের বেশি গুরুতর বা প্রগতিশীল হাইপারগ্লাইসেমিয়া আছে।

সাধারণ ডোজ/মাত্রা: ৫০০ মিলিগ্রাম

মেটফরমিন নির্দেশনা:

  • মেটফরমিন এক্সটেন্ডেড রিলিজ ৫০০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন রাতে একবার খাওয়ার পর নেওয়া হয়। প্রয়োজন অনুসারে ৫০০ মিলিগ্রাম বৃদ্ধি করা হয়, সকাল এবং রাতের খাবারের সাথে ৫০০ মিলিগ্রাম করে দৈনিক ১০০০ মিলিগ্রাম নেওয়া যেতে পারে। 
  • সর্বোচ্চ দৈনিক ডোজ ২৫০০ মিলিগ্রাম।

মেটফরমিন কার্যপ্রক্রিয়া

মেটফরমিন  লিভারে(যকৃতে)  শর্করা উৎপাদন হ্রাস করে, অন্ত্রে শর্করার শোষণ করে এবং শরীরের শর্করা গ্রহণ ও ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা উন্নত করে। গর্ভাবস্থায় মেটফর্মিন জন্মগত অস্বাভাবিকতা বাড়ায় না সাধারণত ভালোভাবে সহ্য করা যায় এবং এটি ইনসুলিনের তুলনায় মায়েদের ওজন বৃদ্ধি কমাতেও সাহায্য করে।

মেটফরমিন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

মেটফরমিন এর সবচেয়ে সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলো-গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল জটিলতা। যার মধ্যে রয়েছে- মুখে ধাতব স্বাদ, বমি বমি ভাব, পেটে অস্বস্তি, হালকা ক্ষুধা লাগা, ডায়রিয়া।

এই লক্ষণগুলো সাধারণত ক্ষণস্থায়ী, ওষুধের ডোজ বৃদ্ধি বা হ্রাসের সাথে বিপরীত হতে পারে। এর একটি বিরল পার্শপ্রতিক্রিয়া ল্যাকটিক অ্যাসিডোসিস।

মেটফরমিন প্রতিনির্দেশনা

  • যেসব রোগীর কিডনিজনিত সমস্যা থাকে তারা মেটফরমিন ব্যবহার করতে পারবে না।
  • গর্ভবতী মহিলার এলার্জির ইতিহাস থাকলে মেটফরমিন ব্যবহারের সুপারিশ করা হয় না।

মেটফরমিন সতর্কতা

কোন কারনে ডোজ নিতে ভুলে গেলে পরবর্তী ডোজের ব্যবধান দেখে ওষুধ খেতে হবে। তবে, কোনভাবেই ডোজ দ্বিগুন করা যাবে না।

মেটফরমিন এর সাথে অন্যান্য ওষুধের মিথস্ক্রিয়া

১. রেনোলাজিন, সিমেটিডিন, ডলুটেগ্রাভির মেটফর্মিন ক্লিয়ারেন্সকে হ্রাস করে, তাই এদের একত্রে ব্যবহারে শরীরে মেটফর্মিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। 

২. অ্যালকোহল ল্যাকটেট মেটাবলিজম এর উপর মেটফরমিনের প্রভাব বাড়ায়।

৩. কার্বনিক অ্য‌ানহাইড্রাস(টপিরাম্যাট,জোনিস্যামাইড) এর সাথে একত্রে ব্যবহারে ল্যাকটিক এসিডোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।  যা খুবই মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। 

পরিশেষে বলা যায়, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়া একটি সাধারণ এবং স্বাভাবিক বিষয়। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন সচেতনতা ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় সহজে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।

সচরাচর জিজ্ঞাসা 

১. ইনসুলিনের কাজ কি?

ইনসুলিন হল অগ্নাশয় এর প্রধান হরমোন এক ধরনের পলিপেপটাইড যা গ্লুকোজকে রক্ত থেকে কোষের মধ্যে প্রবেশ করা নিয়ন্ত্রণ করে, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বজায় রাখে, 

২. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য ইনসুলিন কেন পছন্দ করা হয়?

গর্ভাবস্থায় রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিন হলো প্রথাগত প্রথম পছন্দের ঔষধ কারণ এটি রক্তে শর্করার ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর এবং  এটি প্লাসেন্টা অতিক্রম করে না তাই শিশুর জন্য নিরাপদ।

৩. গর্ভবতী মহিলার কোথায় ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়া উচিত?

গর্ভবতী মহিলাদের পেটে বা   চর্বি যুক্ত জায়গায় ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়া উচিত কারণ ইনসুলিন সবচেয়ে ভালো শোষিত হয়।

৪. গর্ভাবস্থার জন্য কোন ইনসুলিন সেরা?

গর্ভাবস্থায় ইনসুলিনের প্রথম পছন্দ হিসেবে আইসোফ্যান ইনসুলিন( এনপিএইচ) ব্যবহার করা হয়।

৫. ইনসুলিন কি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এর জন্য নিরাপদ?

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়া মহিলাদের জন্য খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করা যথেষ্ট হয়না সাথে ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে। গর্ভাবস্থায় ইনসুলিন নিরাপদ। নির্ধারিত ডায়েট এর সাথে ইনসুলিন গ্রহণ করলে রক্তের শর্করা ঠিক থাকে।

৬. কি করবো যদি মেটফর্মিন ডোজ নিতে ভুলে যাই?

আপনি যদি মেটফর্মিনের একটি ডোজ নিতে ভুলে যান তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি গ্রহণ করুন। তবে আপনার পরবর্তী ডোজ নেওয়ার সময় প্রায় হয়ে গেলে, মিস করা ডোজ এড়িয়ে যান এবং আপনার নিয়মিত সময়সূচীতে ফিরে যান। এক্ষেত্রে ডোজ দ্বিগুণ করবেন না। 

৭. আপনি কি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মেটফরমিন এবং ইনসুলিন একসাথে নিতে পারেন?

ইনসুলিন এবং মেটফরমিন উভয়ই গর্ভাবস্থায় রক্তে শর্করাকে কমাতে ব্যবহৃত হয়। কিছু মহিলার ইনসুলিন এবং মেটফর্মিন একসাথে গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে এবং তারা একসাথে ভালো কাজ করবে।

৮. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কি বিপজ্জনক হতে পারে?

জিডিএম রোগীদের মধ্যে উচ্চ রক্তে শর্করার পরিমাণ মা এবং তার শিশু উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে। মায়ের জন্য, এটি অকাল প্রসব এবং প্রিক্ল্যাম্পসিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।উচ্চ মাতৃ রক্তে শর্করার ফলে শিশুটি খুব বড় হয়ে উঠতে পারে। খুব বড় বাচ্চারা জন্মের সময় আটকে যেতে পারে এবং জন্মগত আঘাত পেতে পারে। বড় আকার এছাড়াও সিজারিয়ান প্রসবের প্রয়োজনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।

৯. মেটফরমিন গ্রহণের সর্বোত্তম সময় কখন?

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে রাতের খাবারের সাথে বা খাওয়ার পরে মেটফরমিন ট্যাবলেট গ্রহণ করা ভালো। ঔষধ পানীয় জলের সাথে গিলে খাবেন, চিবিয়ে খাবেন না।

১০.  গর্ভাবস্থার কোন সপ্তাহে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে কঠিন?

৩২-৩৬ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এর জন্য সবচেয়ে কঠিন সময়। এ সময় ইনসুলিন দিলে ইনসুলিন রেজিস্টেন্সও হয়ে যেতে পারে। 

তথ্যসূত্র

  • Muhas C, Naseef PP. A review article-gestational diabetes mellitus. Int J Curr Pharm Res 2017;9(1):1-5.
  • Janet A.et al,Metformin versus Insulin for the Treatment of Gestational Diabetes,N Engl J Med 2008; 358:2003-2015.
  • Crowther CA, Hiller JE, Moss JR, McPhee AJ, Jeffries WS, Robinson JS. Effect of treatment of gestational diabetes mellitus on pregnancy outcomes. N Engl J Med 2005;352:2477-2486
  • Afsana F, Bhowmik B, Siddiquee T, Ahmed T, Pathan FM, Ahmed T, Samad MA, Uddin MF, Selim S, do Vale Moreira NC, Debnath PR. Current practices in diagnosis and management of gestational diabetes: A Bangladesh study. Journal of Diabetology. 2021 Jul 1;12(5):79.
  • Kampmann U, Madsen LR, Skajaa GO, Iversen DS, Moeller N, Ovesen P. Gestational diabetes: a clinical update. World J Diabetes 6 (8): 1065–1072.

আমি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত আছি। বর্তমানে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও স্বাস্থ্য-সচেতনতার অভাব, যা দৈনন্দিন জীবনে ডেকে আনে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি। একজন ফার্মাসিস্ট হিসেবে আমার অর্জিত ক্ষুদ্র জ্ঞান সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌছে দিতে, আমি সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই। তারই ফলশ্রুতিতে, স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখনী হতে পারে সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম। আমি চাই প্রতিনিয়ত গবেষণামূলক কাজে থেকে নতুন নতুন জ্ঞান আহরন করি এবং সুস্বাস্থ্য ও ঔষধবিষয়ক তথ্য সমৃদ্ধ করতে যেন সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারি। 

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.