অ্যান্টিসাইকোটিক
/

মানসিক ব্যাধির চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের প্রতিকূল প্রভাব, ভয়াবহতা এবং ব্যবস্থাপনা

399 বার পড়া হয়েছে

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করার জন্য মানসিকভাবে সুস্থ থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারা বিশ্বের প্রায় প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক মানসিকভাবে অসুস্থতার শিকার হয়। ২০১৮ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সী প্রায় ৪৭০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা রিপোর্ট করেছে। সাইকোটিক ওষুধগুলো যেমন আমাদের ভালো রাখার মধ্যে একটি অন্যতম উপায়, ঠিক তেমনি এর বিরূপ প্রভাব আমাদের জীবনকে খুব খারাপ ভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

সাইকোটিক ওষুধ এবং এর ব্যবহার

মানসিক ব্যাধির ওষুধ বা অ্যান্টিসাইকোটিক (antipsychotic) বলতে সাধারণত এমন ধরনের ওষুধ কে বোঝায় যা আমাদের আচার-আচরণ, মেজাজ, চিন্তা ভাবনা বা উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে। যেসব ক্ষেত্রে সাধারণত সাইকোটিক ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়-

  • সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia)
  • বাইপোলার ডিজঅর্ডার (Bipolar disorder)
  • ঘুমের সমস্যা (Sleep disorder)
  • বিষন্নতা
  • উদ্বেগ (Anxiety)

 এই ওষুধ গুলো সাধারণত নিউরোট্রান্সমিটার পরিবর্তন করে এই রোগগুলো প্রতিরোধ করে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ওষুধগুলো খুবই গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

অ্যান্টিসাইকোটিক এর প্রকারভেদ

  • জেনারেল অ্যান্টিসাইকোটিকস: ক্লোরপ্রোমাজিন (chlorpromazine), হ্যালোপেরিডল ( haloperidol), ফ্লুফেনাজিন (fluphenazine)
  •  এটিপিক্যাল অ্যান্টিসাইকোটিক: ক্লোজাপাইন (clozapine), ওলানজাপিন (olanzapine),  রিসপেরিডন (risperidone), অ্যারিপাইপ্রাজল (aripiprazole)
  • এন্টিডিপ্রেসেন্ট এজেন্টস: ক্লোনাজেপাম (clonazepam), ডায়াজেপাম (diazepam), লোরাজেপাম (lorazepam)
  • উদ্দীপক (CNS stimulants): এমফিটামিন (amphetamine), মিথাইল ফেনিডেট (methylphenidate), ডেক্সমিথাইল ফেনিডেট (dexmethylphenidate)
  • সিলেক্টিভ সেরেটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর (SSRIs): ফ্লুক্সেটিন ( Fluoxetine), প্যারোক্সিটিন (Paroxetine), সাইট্রউলিন (Citrulline)
  • সেরোটোনিন নরেপিনেফ্রিন রিআপটেক ইনহিবিটর (SNRIs): এটোমোক্সেটিন (atomoxetine) ডুলোক্সেটিন (duloxetine), ভেনলাফেক্সিন(venlafaxine)
  • ট্রাইসাইক্লিক এন্টিডিপ্রেসেন্টস (TCA antidepressants): এমিট্রিপ্টাইলিন (amitriptyline), এমোক্সাপিন (amoxapine), ডেসিপ্রামিন (desipramine), নরট্রিপ্টাইলিন ( nortriptyline)
  • মনো আমিন অক্সিডাইস ইনহিবিটর (MAOIs): ট্র্যানাইলসিপ্রোমিন (Tranylcypromine)
  • মুড স্টেবিলাইজার: কার্বামাজেপিন (Carbamazepine), ল্যামোট্রিগিন (Lamotrigine)

বিভিন্ন প্রকার সাইকোটিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সতর্কীকরণ

সাইকোটিক ওষুধগুলো সাধারণত স্বল্পমেয়াদী চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য রিকমেন্ডেড করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের কারণে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয় ।

১। এন্টিডিপ্রেসেন্ট

এরা সাধারণত বেনজোডায়াজিপাইন (BZD) নামে পরিচিত। এদের ক্ষতিকর প্রভাব এর মধ্যে রয়েছে মাথা ঘোরানো ভারসাম্য হারানো, স্মৃতি সমস্যা, নিম্ন রক্তচাপ, তন্দ্রা। এই ওষুধগুলো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের কারণে ড্রাগ ডিপেন্ডেন্সি হতে পারে।

সিলেক্টিভ সেরেটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর এন্টিডিপ্রেসেন্টস গুলো সাধারণত বিষন্নতার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া বাইপোলার ডিজঅর্ডার এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এর ক্ষতিকর দিক এর মধ্যে রয়েছে ওজন বৃদ্ধি ,বমি,বমি বমি ভাব ইত্যাদি।

সতর্কীকরণ

 কিছু কিছু সিলেক্টেড ইনহিবিটর কারণে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া এর সাথে রক্ত পাতলা করার ওষুধ যেমন- এসপিরিন জাতীয় অ্যান্টিইনফ্লামেটরি ওষুধ ব্যবহারের কারণে রক্ত বা রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে। 

২। সিলেক্টিভ নরেপিনেফ্রিন ইনহিবিটর এন্টিডিপ্রেসেন্টস (Selective norepinephrine inhibitor antidepressants)

এদের ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে মাথা ব্যথা,মাথা ঘোরা, ঘুমের সমস্যা, ক্ষুধা সমস্যা, শুষ্ক মুখ ইত্যাদি।

 সতর্কীকরণ 

এই ওষুধগুলো হৃদস্পন্দন ও যকৃতের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।

৩। মনো অ্যামিন অক্সিডেজ ইনহিবিটর (Monoamine oxidase inhibitor)

এগুলো অনেক পুরনো এবং বর্তমানে প্রায় ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে। এর ক্ষতিকর প্রভাব গুলোর মধ্যে রয়েছে মাথা ঘোরা, ডায়রিয়া, শুষ্ক মুখ, ওজন বৃদ্ধি, বমি বমি ভাব ইত্যাদি।

বিভিন্ন ধরনের খাদ্য যেমন পনির ,আচার এবং শস্যের সাথে টাইরামিন (Tyramine) থাকে যার সাথে এটি বিক্রিয়া করে রক্তচাপকে বাড়িয়ে দিতে পারে।

৪। ট্রাইসাইক্লিক এন্টিডিপ্রেসেন্টস (Tricyclic antidepressants)

এর ক্ষতিকর প্রভাব এর মধ্যে রয়েছে মাইগ্রেন,প্যানিক ব্যাধি, অবসেসিভ বা বাধ্যতামূলক ব্যাধি, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, ওজন বৃদ্ধি ইত্যাদি।

 সতর্কীকরণ 

যাদের গ্লুকোমা, বিবর্ধিত প্রোস্টেট এবং হৃদপিণ্ড জনিত সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধগুলো পরিহার করা উচিত । এছাড়া এই ওষুধগুলো রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে ।

৫। সাধারণ অ্যান্টিসাইকোটিক (General antipsychotics)

এদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ঝাপসা দৃষ্টি , বমি বমি ভাব, ঘুমের সমস্যা, উদ্বেগ, তন্দ্রা, ওজন বৃদ্ধি, যৌন সমস্যা ইত্যাদি ।

সতর্কীকরণ

এই শ্রেণীর ওষুধগুলো সাধারণত এক্সট্রাপিরামিডাল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Extrapyramidal side effects) নামক আন্দোলন সম্পর্কিত ব্যাধি বা মুভমেন্ট ডিজঅর্ডারের ( Parkinson like symptoms) সৃষ্টি করে। যেমনঃ কম্পন, অনিয়ন্ত্রিত মুখের নড়াচড়া, পেশী সমস্যা ইত্যাদি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব এক্সট্রাপিরামিডাল প্রতিক্রিয়াগুলো পারকিনসন ডিজিজ এর অনুরূপ হয়ে থাকে। 

৬। এটিপিক্যাল অ্যান্টিসাইকোটিক (Atypical antipsychotic)

এই ওষুধগুলো সাধারণত বাইপোলার ডিজঅর্ডার, বিষন্নতা, টরেট সিনড্রোম ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এর ক্ষতিকর প্রভাব এর মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা, পেশী খিচুনি, অনৈচ্ছিক আন্দোলন , স্ট্রোক, কোষ্ঠকাঠিন্য,ওজন বৃদ্ধি, ঝাপসা দৃষ্টি ইত্যাদি।

 সতর্কীকরণ  

ক্লোজাপাইন এবং অ্যারিপিপ্রাজল ওষুধগুলো ১৮ বছরের নিচে ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মঘাতী চিন্তাভাবনার সৃষ্টি করে। 

৭। মুড স্টেবিলাইজার (Mood stabilizer)

এরা সাধারণত মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, পেটের সমস্যাজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখায়। 

সতর্কীকরণ 

সাধারণত কিডনি শরীর থেকে লিথিয়াম কে অপসারণ করে থাকে। এই ওষুধগুলো কিডনির কার্যকারিতা কে প্রতিরোধ করে বা বাধা দেয়। তাই এক্ষেত্রে কিডনির কার্যকারিতা নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। 

৮। উদ্দীপক বা স্টিমুলেন্ট (CNS stimulant)

এই ওষুধগুলো সাধারণত মনোযোগ ঘাটতি হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডারে (Attention deficit hyperactivity disorder/ ADHD) ব্যবহার করা হয়। তারা মস্তিষ্কের ডোপামিন এবং এপিনেফ্রিন এর পরিমাণ বাড়ায়।  দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার গুলোর মধ্যে রয়েছে ঘুমের সমস্যা, ওজন হ্রাস পাওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া ইত্যাদি। এছাড়া এই ওষুধগুলো হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি করতে পারে।

এছাড়া সাইকোটিক ওষুধগুলো বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, অ্যালকোহল, ওষুধ , ওটিসি ওষুধের সাথে বিক্রিয়া করে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে সেরোটোনিন সিনড্রোম সহ নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

সাইকোটিক ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাপনায় আমাদের সর্তকতা এবং করণীয়

এফডিএ ( FDA) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে সাইকোটিক ওষুধ এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে-

  •  নিরাপদ প্রেসক্রিপশন এর ক্ষেত্রে ডোজ নির্ধারণের সময় 
  •  একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী যেমন শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের নিরাপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ পর্যবেক্ষণ
  •  ওষুধ ব্যবহারের পূর্বে বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানা

এছাড়াও কয়েকটি ওষুধের  ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সর্তকতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। যেমন-

  •  ১৮ বছরের নিচে বয়সীদের  ক্ষেত্রে অ্যারিপিপ্রাজল ওষুধগুলো নেয়া যাবে না। কারণ এতে আত্মহত্যার চিন্তা ভাবনা থাকতে পারে।
  • এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ গুলো শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার চিন্তা ভাবনাকে আরো বেশি খারাপ করতে পারে।
  • ওপিওয়েড অ্যানালজেসিক যেমন মরফিন, কোকেইন এসব ওষুধের সাথে বেনজোডায়াজিপাইন ওষুধগুলো অত্যন্ত বিপদজনক হতে পারে । তাই এদের একসাথে ব্যবহার বর্জন করতে হবে।
  • ক্লোজাপাইনের কারণে নানা ধরনের রোগব্যাধি সহ খিঁচুনি এবং শ্বাসকষ্টের হতে পারে যা জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
  • অ্যালকোহল এর সাথে সাইকোটিক ওষুধগুলো খাওয়া যাবেনা ।
  • শিশুদের ক্ষেত্রে এবং গর্ভাবস্থায় এই ওষুধগুলো পরিহার করতে হবে ।
  • বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যাদের বিশেষ করে লিভার বা কিডনি ভালোভাবে কাজ করে না তাদের ক্ষেত্রে ওষুধগুলো নেয়া যাবে না।
  •  এছাড়া সাইকোট্রপিক ওষুধ গুলো ব্যবহারের জন্য কিছু বিধিনিষেধ এবং আইন আছে যেগুলো মেনে চলতে হবে।
  • সাইকোটিক ওষুধগুলো ব্যবহারের সময় নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ যেমন আত্মহত্যার চিন্তা, আতঙ্ক, অস্থিরতা ,অনিদ্রা , হৃদ স্পন্দন ও রক্তচাপ বৃদ্ধি , খিচুনি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই খুব দ্রুত জরুরি চিকিৎসা নিতে হবে।

তথ্যসূত্র:

  • Stroup TS, Gray N. Management of common adverse effects of antipsychotic medications. World Psychiatry. 2018 Oct;17(3):341-56
  • Moncrieff J, Leo J (September 2010). “A systematic review of the effects of antipsychotic drugs on brain volume”. Psychological Medicine. 40 (9): 1409–1422.
  • Muench J, Hamer AM. Adverse effects of antipsychotic medications. American family physician. 2010 Mar 1;81(5):617-22.
  • Antipsychotics – What you need to know;13th Feb 2022 Available  from https://www.rethink.org/advice-and-information/living-with-mental-illness/medications/antipsychotics/
  • Ghoshal M. What is a psychotropic Drug? Types, Uses, Side Effects, Risks & More; 13th Feb 2022 Available from- https://www.healthline.com/health/what-is-a-psychotropic-drug

আমি আনিসা ইবনাত। বর্তমানে পড়াশোনা করছি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী (প্রফেশনাল) বিভাগের ৫ম বর্ষে। শুরু থেকেই বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন জিনিস জানা এবং লিখালিখির বেশ আগ্রহ ছিল। আর এইরকম অনলাইন প্লাটফর্মগুলোর মাধ্যমেই সে ইচ্ছা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। একজন ঔষধ বিষয়ক শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞান টুকুকে সবার মাঝে ছড়িয়ে সচেতনতা তৈরি এবং গবেষণার মাধ্যমে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই।

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.