এন্টিডিপ্রেসেন্ট (Antidepressant): কি, শ্রেনিবিভাগ, নির্বাচন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে করণীয়
//

হতাশায় ভুগছেন — যেনে নিন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

246 বার পড়া হয়েছে

সকল ব্যক্তি জীবনের কোন একটি নির্দিষ্ট সময় মানসিক বিষন্নতার মধ্য দিয়ে পার করে থাকেন। সাধারণত ব্যক্তিটি সময়ের সাথে সাথে এই বিষন্নতাটি কাটিয়ে উঠেন। বর্তমানে প্রায় সকল তরুণদের মধ্যে এই সমস্যাটি কম বেশি দেখা যায়। যে সকল ব্যক্তিগণ এই মানসিক বিষন্নতা সহজে কাটিয়ে উঠতে পারেননা তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পর চূড়ান্ত হতাশায় পড়ে যায় যাদের আমরা হতাশাগ্রস্থ বলি জেনে থাকি। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সাধারণ পরামর্শ (Counselling) গ্রহনের মাধ্যমে অনেকেই এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন। কিন্তু কিছু মানুষের এই সাধারন পরামর্শের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় কিছু ঔষধের যা আমরা এন্টিডিপ্রেসেন্ট (Antidepressant) ঔষধ হিসেবে জেনে থাকি। 

বর্তমান বিশ্বে এবং বাংলাদেশে হতাশার পাদুর্ভাব কেমন?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বের প্রায় ৫% তরুণ হতাশায় ভুগে। পুরুষের তুলনায় মহিলারা এই রোগের ভুক্তভোগী বেশি। বর্তমান বিশ্বের ৩.৮% এর বেশি মানুষ হতাশায় ভুগে থাকেন। যে সকল ব্যক্তি দীর্ঘদিন  হতাশায় ভুগেন তাদের আত্মহননের প্রবণতা বেশি হয়ে থাকে। প্রতিবছর প্রায় ৭ লক্ষ্যেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। মৃত্যুর কারণগুলির মধ্যে আত্মহত্যা প্রধান চার নম্বর কারণ হিসেবে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের জন্য এই চিত্র ভিন্ন নয়, বাংলাদেশে ৭০ লক্ষের মতো মানুষ হতাশা বিষন্নতায় ভুগছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে একটি জরিপে দেখা গেছে যে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী হতাশা ও মানসিক বিষণ্ণতায় ভুগছেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যে একটি জরিপে দেখা গেছে যে, ২০১৫ সালে মানসিক বিষণ্ণতায় ভোগা ছাত্র-ছাত্রীর পরিমাণ ২৪ শতাংশ যা ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৯.৫ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। 

বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কার্যকরী চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও মধ্যম ও কম আয়ের দেশের মানুষের মধ্যে ৭৫ শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কোন চিকিৎসা গ্রহণ করেননা। এই মানুষের মধ্যে চিকিৎসা গ্রহণের মূল বাধা সমূহ হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা, পর্যাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্যবীদের স্বল্পতা এবং এবং সামাজিকভাবে বিভাজনের ভয়। 

কোন ব্যক্তি চূড়ান্ত হতাশায় ভুগছেন কিনা বোঝার উপায় কি?

সকল মানুষই কম বেশি সময় বিষন্নতার মধ্য দিয়ে পার করেন। কিন্তু চূড়ান্তভাবে হতাশাগ্রস্থ মানুষ তখনই বলা যাবে যখন ওই ব্যক্তির মধ্যে নিম্নোক্ত লক্ষণ গুলোর মধ্যে কমপক্ষে তিনটি লক্ষণ দেখা যাবে। লক্ষণগুলো হচ্ছে,

  • দীর্ঘদিন যাবত হীনমন্যতায় ভোগা, নিজের ভেতর শূন্যতা অনুভব করা অথবা বিষন্ন থাকা। 
  • কোন আনন্দ উপভোগকারী কাজে আনন্দ উপভোগ করতে না পারা। যেমন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া অথবা শখের কোন কাজ করা। 
  • সহজেই বিরক্ত হওয়া। 
  • নিজেকে অপরাধী মনে করা, কোন বিষয়ে সহজেই নিরাশ হওয়া এবং নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা। 
  • অতিরিক্ত ঘুম হওয়া অথবা নিদ্রাহীনতায় ভোগা। 
  • আকস্মিক ওজন বৃদ্ধি অথবা ওজন হীনতা। 
  • আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যু চিন্তা করা। 
  • অবসাদ এবং দুর্বল অনুভব করা। 
  • কোন কাজে সহজে মনোযোগ দিতে না পারা এবং ছন্নছাড়া হয়ে থাকা। 
  • কোন রোগ না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা অনুভব করা। যেমন, পেটে ব্যথা অথবা শরীরের অন্য কোন অঙ্গে অপ্রত্যাশিত ব্যাথা অনুভব করা।

বিভিন্ন ধরনের ঔষধ যা হতাশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয় 

এন্টিডিপ্রেসেন্ট (Antidepressant) ঔষধ সমূহ হতাশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। এই ওষুধগুলোকে তাদের রাসায়নিক গঠন ও মানব শরীরে কাজ করার পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন,

  • ট্রাইসাইক্লিক এন্টিডিপ্রেসেন্ট (Tricyclic antidepressant; TCAs) 
  • মনোঅ্যামিনো অক্সিডেস ইনহিবিটর (Monoamine oxidase inhibitors; MAOIs)
  • সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিয়াপটেক ইনহিবিটর (Selective serotonin reuptake inhibitor; SSRIs)
  • সেরোটোনিন-নরঅ্যাডরেনালিন রিয়াপটেক ইনহিবিটর (Serotonin-noradrenaline reuptake inhibitors; SNRIs)
  • অ্যাটিপিকাল এন্টিডিপ্রেসেন্ট (Atypical antidepressant)

প্রতিটি ঔষধের গ্রুপের আলাদা আলাদা উপকার, অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং ব্যবহার রয়েছে। রোগীর মানসিক অবস্থা এবং বিষন্নতার মাত্র উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন গ্রুপের ঔষধ চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাছাই করা হয়। 

কিভাবে এন্টিডিপ্রেসেন্ট গুলো কাজ করে? 

তিনটি প্রধান ধরণ রয়েছে, যার রাসায়নিকভাবে মনোঅ্যামিন (Monoamine) হিসেবে পরিচিত যা মানসিক আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত। এগুলো প্রাথমিকভাবে নিউরোট্রান্সমিটার (Neurotransmitter) হিসেবে কাজ করে, যা মস্তিষ্কে তাদের সংশ্লিষ্ট রিসিপ্টর (Receptor) গুলিতে স্নায়ুর সংকেত প্রেরণ করে। যার মধ্যে রয়েছে, 

  • ডোপামিন (Dopamine): এটি সিদ্ধান্ত গ্রহন, উত্তেজনা, অনুপ্রেরণা এবং আনন্দ সংকেত গুলিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। 
  • নরএপিনেফ্রিন (Norepinephrine): এটি রক্তচাপ, হৃদপিন্ডের স্পন্দন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা, মানসিক সতর্কতাএবং মটর ফাংশন নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করে। 
  • সেরোটোনিন (Serotonin): এটি মেজাজ,  ক্ষুদা ঘুম, স্মৃতিশক্তি, সামাজিক আচরণ এবং যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে। 

হতাশা আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে, মস্তিষ্কে এই নিউরোট্রান্সমিটার গুলোর পরিমাণ কমে যায়। এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ গুলো স্বতন্ত্র উপায়ে এক বা একাধিক নিউরোট্রান্সমিটার গুলোর প্রাপ্যতা মস্তিষ্কে বাড়িয়ে দেয়। হতাশায় প্রথম সারির চিকিৎসার ক্ষেত্রে, সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিয়াপটেক ইনহিবিটর (Selective serotonin reuptake inhibitor; SSRIs) এবং সেরোটোনিন-নরঅ্যাডরেনালিন রিয়াপটেক ইনহিবিটর (Serotonin-noradrenaline reuptake inhibitors; SNRIs) সর্বাধিক সাধারণভাবে নির্বাচিত করা হয়। অন্যান্য এন্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে যদি এই ওষুধগুলো ব্যর্থ হয়। 

সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিয়াপটেক ইনহিবিটর (Selective serotonin reuptake inhibitor; SSRIs)

অনেকগুলো এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ রয়েছে যা স্নায়ুতন্ত্রের দুইটি স্নায়ু কোষের মধ্যবর্তী ফাঁকা অংশ সাইন্যাক্টিক ক্লেফট (Synaptic cleft) হতে স্নায়ু কোষে নিউরোট্রান্সমিটারের পুনঃশোষণ বাধা দেয়। যার ফলে স্নায়ুকোষের মধ্যবর্তী ফাঁকা অংশে অর্থাৎ সাইন্যাক্টিক ক্লেফটে (Synaptic cleft) নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণ বজায় থাকে। এই ধরনের ঔষধ গুলোকে রিআপটেট ইনহিবিটার বলা হয়। যখন কোন ওষুধ শুধুমাত্র সেরিটোনিনের রিয়াপটেককে বাধা দিবে তখন সেই ওষুধগুলোকে সেরোটোনিন-নরঅ্যাডরেনালিন রিয়াপটেক ইনহিবিটর(SSRIs) বলা হয়ে থাকে। এই গ্রুপের ঔষধ গুলো হচ্ছে,

  • সিটালোপ্রাম (Citalopram)
  • এসসিটালোপ্রাম (Escitalopram
  • ফ্লুঅক্সেটিন (Fluoxetin)
  • ফ্লুভক্সামিন (Fluvoxamine)
  • ভিলাযোডন (Vilazodone)
  • সারট্রালিন (Sertraline)
  • পারঅক্সাটিন (Paroxetine)

এই গ্রুপের এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পুরাতন এন্টিডিপ্রেসেন্টট্রাইসাইক্লিক এন্টিডিপ্রেসেন্ট (Tricyclic antidepressant; TCAs), মনোঅ্যামিনো অক্সিডেস ইনহিবিটর (Monoamine oxidase inhibitors; MAOIs) ঔষধের চেয়ে  তুলনামূলকভাবে কম। এদের সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক গুলো হচ্ছে বমি বমি ভাব, নিদ্রাহীনতা, নার্ভাসনেস(Nervousness) এবং কাঁপুনি। তবে দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে এই ওষুধগুলো যৌন জীবনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। 

হতাশা রোগের পাশাপাশি এই ওষুধগুলো অন্যান্য অনেক মানসিক রোগের জন্য ব্যবহৃত হয়। অভসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (Obsessive compulsive disorder; OCD), জেনারালাইসড এনজাইটি ডিসঅর্ডার (Generalized anxiety disorder; GAD), ইটিং ডিসঅর্ডার (Eating disorder, ED) ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া এই গ্রুপের ওষুধগুলো হৃদ যন্ত্রের রোগীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। 

সেরোটোনিন-নরঅ্যাডরেনালিন রিয়াপটেক ইনহিবিটর (Serotonin-noradrenaline reuptake inhibitors; SNRIs)

এই গ্রুপের ওষুধগুলো সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিয়াপটেক ইনহিবিটরের মতো কাজ করে শুধুমাত্র পার্থক্য এই জায়গায় যে এই ওষুধগুলো সেরোটোনিনের সাথে নরএপিনেফ্রিন নিউরো  ট্রান্সমিটারের পুনঃশোষণকে বাধা দেয়।  এই গ্রুপের ঔষধ সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সালে এফডিএ(FDA) অনুমোদন পায়। সেরোটোনিনের মাত্রার সাথে নরএপিনেফ্রিন মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এই ওষুধটি ঐ সকল রোগীদের জন্য বেশি কার্যকরী যাদের চিন্তা করার গতি একটু কম এবং শারীরিক নাড়াচাড়া কম করতে পারে। এই গ্রুপের কিছু ওষুধ গুলোর নাম হচ্ছে, 

  • ডুলঅক্সেটিন (Duloxetine)
  • মিলনাসিপ্রাম (Milnacipram)
  • লেভোমিলনাসিপ্রাম (Levomilnacipram)
  • ডেসভেনলাফ্যাক্সিন (Desvenlafaxine)
  • ভেনলাফ্যাক্সিন (Venlafaxine)

এই ওষুধ গুলির কিছু সাধারন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে যেগুলো হচ্ছে বমি বমি ভাব, তন্দ্রাচ্ছন্নতা, অবসাদগ্রস্ত হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং লালা নিঃসরণ কমে যাওয়া যার ফলে মুখ ও গলা শুকিয়ে আসে। 

তবে এই ওষুধগুলোরও নানাবিধ ব্যবহার আছে যদি কোন ব্যক্তি দীর্ঘদিন যাবত কোন ব্যথার অসুখে ভোগেন হলে তার মধ্যে বিষাদগ্রস্ত থাকার একটি প্রবণতা থাকে অথবা যদি কোন ব্যক্তি বড় কোন দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে যান এর ফলে ওই ব্যক্তির মধ্যে যে বিষন্নতা অনুভূত হয় (Post-traumatic stress disorder; PTSD) তখন এই ওষুধ গুলো ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সোশ্যাল অ্যাংজাইটি (social anxity), প্যানিক ডিসঅর্ডার (Panic disorder), স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপনায় তৈরি হওয়া ব্যথা (Nerve pain) নিরাময়ে এ ঔষধ ব্যবহৃত হয়।

ট্রাইসাইক্লিক এন্টিডিপ্রেসেন্ট (Tricyclic antidepressant; TCAs) 

এই গ্রুপের ওষুধগুলো এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন ঔষধ। ১৯৫০ সালে এই শ্রেণীর ঔষধ প্রথম আবিষ্কৃত হয়। রাসায়নিক গঠন রাসায়নিক গঠনের উপর ভিত্তি করে এদের নামকরণ করা হয়৷ এই ওষুধগুলো সেরোটোনিনের, নরএপিনেফ্রিন সেই সাথে এসিটাইলকোলিন (Acetylcholine)  নিউরো  ট্রান্সমিটারের পুনঃশোষণকে বাধা দেয়। নিম্নে এই গ্রুপের কিছু ওষুধের নাম দেয়া হলো, 

  • ক্লোমিপ্রামিন (clomipramine)
  • এমক্সিপাইন (amoxapine)
  • এমিট্রিপটাইলিন (amitriptyline)
  • ডেসইমিপ্রামিন (desimipramine)
  • নরট্রিপ্টাইলিন (nortriptyline)
  • ডক্সেপিন (doxepin)
  • ট্রাইইমিপ্রামিন (trimipramine)
  • ইমিপ্রামিন (imipramine)
  • প্রট্রিপ্টাইলিন (protriptyline)

এই ওষুধগুলোর কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে ঘুম ঘুম ভাব, মাথা ঘোরা, অথবা ঝিমঝিম করা, কোষ্ঠকাঠিন্য, দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসা, লালা গ্রন্থির ক্ষরণ কম হওয়ায় মুখ ও গলা শুকিয়ে আসা এছাড়া দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ওজন বৃদ্ধি ঘটে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত হৃদ স্পন্দন, রক্তচাপ কমে যাওয়া এমনকি খিচুনি পর্যন্ত হতে পারে। 

এই ওষুধটিরও নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। এটি দীর্ঘদিনের ব্যথা এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অত্যাধিক চঞ্চল এবং অমনোযোগী রোগের (Attention deficit hyperactivity disorder; ADHD) ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

মনোঅ্যামিনো অক্সিডেস ইনহিবিটর (Monoamine oxidase inhibitors; MAOIs)

এই ওষুধটি মনোঅ্যামিনো অক্সিডেজ (Monoamino oxidase) এনজাইমকে মনোঅ্যামিনো অক্সিডেশনে ঘটাতে বাধা দেয়। যার ফলে সাইন্যাপটিক ক্লেফটে মনোঅ্যামিনের মেটাবলিজম হয় না। যার ফলে এর পরিমাণ সাইন্যাপটিক ক্লেফটে বজায় থাকে।  এই গ্রুপের কিছু ড্রাগের উদাহরণ হচ্ছে, 

  • সেলেগিলিন (selegiline)
  • আইসোকার্বোঅক্সাজিড (isocarboxazid)
  • ফেনেলজিন (phenelzine)
  • ট্রানিলসাইপ্রোমাইন (tranylcypromine)

এই গ্রুপের ঔষধ গুলো খুবই কম ব্যবহৃত হয় কারণ এই ঔষধগুলো টাইরামিন (Tyramine) উপস্থিত খাদ্য সমূহের সাথে গ্রহণ করলে শরীরে টাইরামিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় যা আকস্মিক উচ্চ রক্তচাপের সাথে জড়িত। এই ঔষধ গুলো ব্যবহার করতে হলে নিয়মিত খাদ্য গ্রহণে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া এদের কিছু সাধারন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে যেমন বমি বমি ভাব, মাথা ঝিমঝিম করা, ঘুম ঘুম ভাব, ছটফট করা, এবং রাতের বেলায় নিদ্রাহীনতা। 

ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, এই ওষুধগুলো অ্যাগোরাফোবিয়া (Agoraphobia), সামাজিক ফোবিয়া (Social fobia), বুলিমিয়া (Bulimia), দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলে অনুভূত বিষণ্নতা (Post-traumatic stress disorder; PTSD), বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (Borderline personality disorder) এবং বাইপোলার ডিপ্রেশনের (Bipolar Depression) চিকিৎসায় কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। যখন অন্যান্য গ্রুপের এন্টিডিপ্রেসেন্ট বিকল্পগুলো ব্যর্থ হয় তখনই এই ওষুধটি শুধুমাত্র ব্যবহৃত হয়। 

অ্যাটিপিকাল এন্টিডিপ্রেসেন্ট (Atypical antidepressant) 

অ্যাটিপিকাল অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টগুলি সাধারণ নয়।  এগুলি অন্যান্য শ্রেণীর অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টগুলির সাথে খাপ খায় না। এগুলি প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওষুধ যা একে অপরের থেকে বিভিন্ন উপায়ে শরীরে কাজ করে। অ্যাটিপিকাল এন্টিডিপ্রেসেন্ট এক বা একাধিক নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা পরিবর্তন করে, যেমন ডোপামিন, সেরোটোনিন বা নরএপিনেফ্রিন।

  • বুপ্রোপিয়ন (Bupropion)
  • মিরটাজাপাইন (Mirtazapine
  • নেফাজোডোন (Nefazodone)
  • ট্রাজোডোন (Trazodone)
  • ভিলাজোডোন (Vilazodone)
  • ভরটিঅফক্সেটিন (Vortioxetine)

এই গ্রুপের প্রতিটি ঔষধের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে তারা মানব শরীরে বিভিন্ন উপায়ে ফার্মাকোলজিক্যাল (Pharmocological) প্রতিক্রিয়া প্রদান করে থাকে। তবে অন্যান্য গ্রুপের ওষুধ গুলোর মত এরাও কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রদান করে থাকে। মাথা ঘোরা, রাতে ঘুম না আসা, মুখো গলা শুকিয়ে আসা, কিছু ওষুধ ডায়রিয়া আবার কিছু ওষুধ কোষ্ঠকাঠিন্য তৈরি করে থাকে।  কিছু ড্রাগ আবার ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 

সঠিক এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ নির্বাচনের গুরুত্ব  কি?

সঠিক এন্টিডিপ্রেসেন্ট বেছে নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে তার মধ্যে প্রধান হলো সহনশীলতা। বিভিন্ন গ্রুপের এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ গুলো সমানভাবে কার্যকর হলেও এদের কিছু বিরূপ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে । কিছু কিছু ওষুধ দীর্ঘ মেয়াদে গ্রহণ করলে বড় কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয় যা ব্যক্তি জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া একটি ব্যক্তিজীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করতে পারে। এই ঔষধ গুলো খুবই গুরুত্ব সহকারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করতে হবে। বিষন্নতায় বিভিন্ন সাইকো থেরাপি, সামাজিক সহায়তা, স্ব-সহায়তা মাধ্যমে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা পর্যালোচনা করে নির্দিষ্ট গ্রুপের ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। 

কিভাবে এন্টিডিপ্রেসেন্ট এর অপব্যবহার হয়? 

বেশিরভাগ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের অপব্যবহার মূল কারণ হচ্ছে সাধারণত কেউ তাদের নির্ধারিত ডোজ নিজ থেকে বাড়িয়ে দেয় যখন তারা মনে করে যে ওষুধটি যথেষ্ট দ্রুত কাজ করছে না। কিছু লোক ওষুধের প্রভাব বাড়ানোর প্রয়াসে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টসকে অন্যান্য পদার্থের সাথে একত্রিত করে সেবন করে , যেমন অ্যালকোহলের সাথে একত্রে সেবন করা । দীর্ঘদিন এরকম অপব্যবহারের ফলে সময়ের সাথে সাথে এন্টিডিপ্রেসেন্টস ঔষধ গুলো ওই সকল ব্যক্তির মধ্যে  কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে যদিও তাদেরই এন্টিডিপ্রেসেন্টস ঔষধগুলোর খুব বেশি প্রয়োজন ছিল । যখন কোন ব্যক্তি এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ নেওয়ার পরও যদি মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি না পায় তখন এটি কিছু ব্যবহারকারীকে তাদের ডোজ বাড়াতে পরিচালিত করতে পারে।

এন্টিডিপ্রেসেন্টস এবং আত্মহত্যা ঝুঁকির সাথে কি কোন সম্পর্ক আছে? 

বেশিরভাগ এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধই সাধারণত নিরাপদ তবে ইউএস ড্রাগ এন্ড ফুড এডমিনিস্ট্রেশন (FDA) এই ওষুধগুলোর প্রেসক্রিপশন করার জন্য ব্ল্যাক বক্স (Black box) প্রতীকের মাধ্যমে কঠোরতম সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বলেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে শিশু, কিশোর এবং ২৫ বছরের কম বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে এন্টডিপ্রেসেন্ট গ্রহণ করার ফলে আচরণগত পরিবর্তন এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়, এই ঘটনাটি তখনই ঘটে যখন এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ গ্রহণ করার কিছু সপ্তাহ পরেই যদি ডোজ পরিবর্তন করা হয়। এজন্য এই ঔষধ গুলির প্রেসক্রিপশনে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। 

যখন কোন ব্যক্তি এন্টিডিপ্রেসেন্ট  ঔষধ গুলো গ্রহন করতে থাকে তখন সব সময় তাকে পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হবে। ওই ব্যক্তির যদি কোন অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হয় যা তিনি পূর্বে কখনো দেখাননি এবং যদি আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা করেন তখন অবিলম্বে ওই ব্যক্তিকে স্বাস্থ্য সেবা প্রধান কারীর সাথে যোগাযোগ করাতে হবে অথবা জরুরী সাহায্য দিতে হবে। তবে এই বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না যে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধগুলো সঠিক মাত্রায় নিয়মিত ব্যবহারের ফলে আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে। 

এন্টডিপ্রেসেন্ট ঔষধ গুলিকে ফার্মাকোলজিক্যালি (Pharmacologically) কিভাবে মানব শরীরে অধিক কার্যকরী করে তোলা যায়?

একটি এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের সঠিক ও কার্যকরী ফলাফল পেতে হলে, 

  • রোগীকে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে কারণ এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ গুলো সেবনের ছয় থেকে সাত সপ্তাহ পর থেকে কার্যকারিতা দেখানো শুরু করে। তবে বিষন্নতার উপসর্গের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক সময়ের সাথে সাথে ঔষধের ডোজের পরিবর্তন করতে পারেন। 
  • যদি মনে হয় যে ওষুধগুলো নিয়মিত এবং সঠিক মাত্রায় ব্যবহারের পরও সঠিকভাবে কাজ করছে না বা বিরুপ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া  দেখাচ্ছে , তখন অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। 
  • প্রাথমিকভাবে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হলেও ধীরে ধীরে শরীর ওষুধের সাথে সামঞ্জস্যতা তৈরীর মাধ্যমে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলোকে তাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ কিছু সময় শরীরকে দিতে হবে এবং ধৈর্যশীল হতে হবে। যেমন, সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিয়াপটেক ইনহিবিটর (Selective serotonin reuptake inhibitor; SSRIs) গ্রহণের ফলে প্রাথমিকভাবে বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা এবং অনিদ্রা পর্যন্ত হতে পারে প্রতিক্রিয়াগুলো সাধারণত চলে যায় কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলো চলে যায় কারণ শরীর ও তখন ওষুধের সাথে সামঞ্জস্যতা তৈরি করে ফেলে। 
  • অনেক সময় এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ গুলোর পাশাপাশি সাইকোথেরাপি গ্রহণ করা হলে দ্রুত রোগ নিরাময় সহায়তা করে, যা একা এন্টিডিপ্রেসেন্ট গ্রহণের চেয়ে বেশি কার্যকর । 
  • স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনভাবেই এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ গুলো বন্ধ করা যাবে না। ধীরে ধীরে ডোজ কমিয়ে দিলে অথবা আকস্মিক  বন্ধ করে দিলে বিষন্নতা পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। 
  • অ্যালকোহল এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক ওষুধ এড়িয়ে চলতে হবে কারণ এগুলো এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের সক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এটি মনে হতে পারে যে অ্যালকোহল বা বিনোদনমূলক ওষুধগুলো হতাশার লক্ষণগুলোকে কমিয়ে দিচ্ছে। তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর অ্যালকোহল এবং ওই ঔষধ গুলো বিষন্নতার লক্ষণ গুলোকে আরো কঠিন এবং খারাপ করে তোলে। 

আমি মোঃ মাহমুদ হোসেন। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত আছি। আমার স্থায়ী বাসস্থান চাঁদপুর। তবে স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে ঢাকায়। নিজের মনের চিন্তা ভাবনা গুলোকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্যই মূলত লেখালেখি করি। বিশ্বের নতুন কোন আবিষ্কার বা নতুন কোন জিনিস সম্পর্কে জানার আগ্রহ খুবই বেশি। সেই আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন বই, পত্রিকার সংখ্যা ও আরো অন্যান্য অনেক সূত্র হতে নিয়মিত পড়াশোনা করি। পড়াশোনার মাধ্যমে নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞানের পরিধিকে বর্ধিত করার চেষ্টা করি। তার থেকে যা কিছু বুঝি তার সংক্ষেপে গুছিয়ে লিখার চেষ্টা করি। 

1 Comment

  1. […] হতাশা বা বিষণ্ণতা হল সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির মধ্যে একটি। এটি মৃদু এবং স্বল্পস্থায়ী হতে পারে, অথবা এটি তীব্র, গুরুতর ও সেই সাথে দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থায়ী হতে পারে। সাধারনত মানসিক নির্যাতন, স্কুলে বা পারিপার্শ্বিক সহিংসতা, ঘনিষ্ঠ মানুষ বা বন্ধুর মৃত্যু, পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যা যেমন পরিবার ভাঙার মতো বিষয়গুলির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বিষণ্ণতা বা হতাশার সৃষ্টি হতে পারে। দীর্ঘ সময়ের জন্য চাপে (Stress) থাকার দরুন  কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রেও এ ধরনের মানসিক সমস্যা হতে পারে।  […]

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.