সকল পদার্থই বিষ এবং কেবল মাত্র একটি ঔষধের সঠিক মাত্রাই নির্ধারণ করে এটি রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রাখবে নাকি সেবন পরবর্তীতে শরীরে বিষাক্ততা সৃষ্টি করবে।
সুইশ চিকিৎসক ও দার্শনিক প্যারাসেলসাস
টক্সিকোলজি (Toxicology) বলতে জীবের উপর উচ্চমাত্রার ঔষুধ তথা কেমিক্যাল পদার্থসমূহের বিরূপ প্রভাব সম্বলিত জ্ঞানকে বুঝায়। আর ক্লিনিক্যাল টক্সিকোলজি (Clinical Toxicology) হচ্ছে টক্সিকোলজির একটি শাখা যেখানে দুর্ঘটনাক্রমে বা স্বেচ্ছায় মাত্রাতিরিক্ত ঔষধ সেবনজনিত কারনে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত একজন রোগীর চিকিৎসা সেবা ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করে।
উন্নত দেশগুলোতে ওষুধের বিষক্রিয়া চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার জন্য ‘পয়জন সেন্টার‘ (poison centre) নামক স্বয়ংক্রিয় প্রতিষ্ঠান থাকে। ডাক্তার, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট ও নার্সদের সমন্বয়ে এই প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া তারা ২৪ঘন্টা ফোনকলে ঔষধের বিষক্রিয়ার পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্যে বিষক্রিয়া, গৃহস্থালী পণ্য, কীটনাশক, উদ্ভিজ ও প্রানীজ পন্য এবং কসমেটিকস পন্য ব্যবহারে বিষক্রিয়া সম্পর্কিত ঘটনাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে, অতঃপর তথ্যসমূহ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষন করে মানুষকে তৎক্ষনাৎ উপর্যুক্ত তথ্য ও প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে। এছাড়া তারা গণসচেতনতা মূলক শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহন করে থাকে যেন মানুষ সহজেই বিষক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকার সম্পর্কে সাধারন জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
বিষক্রিয়ার চিকিৎসার আগে ডাক্তার কিংবা ফার্মাসিস্টরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধারনা নিয়ে রাখেন যেমন রোগীর বয়স ও ওজন, রোগী কি ধরনের কেমিক্যাল বা ঔষধ নিয়েছেন, কি পরিমান নিয়েছেন, নেওয়ার পর থেকে সময় কতটা অতিবাহিত হল, বিষক্রিয়ার লক্ষনসমূহ কি কি প্রকাশ পাচ্ছে বা রোগী বিষক্রিয়া নিয়ন্ত্রনের জন্য নিজেই কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা ইত্যাদি।
বিষক্রিয়ায় সামগ্রিক চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাকে নিম্নোক্ত চার ধাপে বর্ণনা করা যায়ঃ
১. সহায়ক ব্যাবস্থাপনা নিশ্চিতকরন যেমনঃ তৎক্ষনাৎ বমির উদ্রেক কিংবা ‘গ্যাস্ট্রিক লেভেজ’ (Gastric lavage) এর মাধ্যমে পাকস্থলী খালি করা।
২. সক্রিয় শোষনকারী পদার্থ যেমন, একটিভেটেড চারকোল (কাঠকয়লার গুড়ো) (Activated charcoal) খাওয়ানোর মাধ্যমে রক্তে ঔষধের উপস্থিতির হার কমিয়ে আনা। এই উদ্দেশ্যে কিছু ক্যাথারটিক্সও(cathartics) (বিরেচক ঔষুধ) ব্যবহার করা হয় যারা পরিপাক নালি পরিষ্কারের মাধ্যমে শরীর থেকে দ্রুত নিষ্কাশনে সাহায্য করে।
৩. যদি রক্তে ইতিমধ্যে শোষিত হয়ে যায় তখন শরীর থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঔষুধের রেচন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা। এটি আবার চার ভাবে করা যায়ঃ
ক) বেশ কয়েকটি ডোজে একটিভেটেড চারকোল খাওয়ানো।
খ) মূত্রবর্ধক ঔষুধ (Diuretics) খাইয়ে প্রস্রাবের মাধ্যমে পয়জনের নিষ্কাশন বাড়ানো।
গ) প্রস্রাবের অম্লত্ব বা ক্ষারকত্ব (পিএইচ) (pH) পরিবর্তনের মাধ্যমে নিষ্কাশন তরান্বিত করা।
ঘ) হেমোডায়লাইসিস এবং হেমোপারফিউশন প্রসেসের মাধ্যমে রক্তে দ্রবীভূত মাত্রাতিরিক্ত পদার্থের অপসারন করা।
৪. নির্দিষ্ট বিষক্রিয়ার বিপরীতে নির্দিষ্ট অ্যান্টিডোট দেওয়া।
পাকস্থলী ও পরিপাকনালী থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঔষধ কিংবা পয়জন দূরীকরণের জন্যে বাংলাদেশে উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালই যথেষ্ঠ। কিন্তু সময় বেশি অতিবাহিত হওয়ার দরুন রক্তে শোষিত হয়ে গেলে তার শনাক্তকরণ ও দূরীকরণে জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল বা আরো উন্নত ক্লিনিক্যাল সেটআপের প্রয়োজন হয়।
ইপিক্যাক (Epicac) এক ধরনের এলাকালয়েডধর্মী (alkaloid) পদার্থ যা প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়। এটি বাজারে সিরাপ আকারে পাওয়া যায় যা একটি বহুল প্রচলিত বমি উদ্রেককারী (Emetics) ঔষধ। এটি বাজারে ১০মিলি ও ১৫মিলি বোতল আকারে পাওয়া যায়। সাধারণত শিশুদের জন্য এই সিরাপের ১৫মিলি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য 30 মিলি ডোজ ১২-১৪ মিনিটের মধ্যেই বমি ঘটাতে সক্ষম। বমির মাধ্যমে পাকস্থলী থেকে সহজেই পয়জন বেরিয়ে আসে। তবে এই প্রক্রিয়ায় রোগীরা কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগে থাকে, যেমন দীর্ঘক্ষন যাবৎ বমি হতে থাকা,পাতলা পায়খানা হওয়া, ঘুম ঘুম ভাব ইত্যাদি।
আবার কিছু কিছু রোগীর বমি ঘটানোর জন্য ইপিক্যাক সিরাপ ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ বা অকার্যকর হয়ে থাকে। যেমন-
- মৃগীরোগীদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ কারণ পয়জন মিশ্রিত পাকস্থলির খাদ্যদ্রব্য তাদের শ্বাসনালীতে চলে যেতে পারে। তখন রোগীর শারিরীক পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
- তাছাড়া যারা ক্ষয়কারক পদার্থ সেবনজনিত কারনে বিষক্রিয়ায় ভুগে তাদেরও এই সিরাপ দেওয়া যায় না। কেননা এটি পরিপাক নালিকে বিনষ্ট করতে পারে।
অন্যদিকে ‘গ্যাস্ট্রিক লেভেজ’ হচ্ছে একটি মেডিকেল প্রক্রিয়া যেখানে পাকস্থলি বরাবর তরল সমৃদ্ধ একটি টিউব ঢুকিয়ে ঐই একই পথে পাকস্থলীর ভিতরকার পদার্থসমূহ বের করে আনা হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে হসপিটাল বেডে বাম কাত করে শোয়ানো হয়। গ্যাস্ট্রিক লেভেজ কোমায় (অজ্ঞান রোগী) চলে যাওয়া রোগীর ক্ষেত্রেও পরিচালনা করা যায়, কিন্তু তাদেরকে ইপিক্যাক সিরাপ খাওয়ানো যায় না। কিন্তু রোগী যদি অতীব ক্ষয়কারক পদার্থ খেয়ে ফেলে তখনও তাদের ক্ষেত্রে লেভেজ প্রক্রিয়া অনুসরন করা যায়না, কারন লেভেজ টিউব যখন অতিক্রম করে এটি পাকস্থলীর মিউকাস মেমব্রেনকে আরো ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়।
অপরদিকে একটিভেটেড চারকোল একটি গন্ধহীন- স্বাধহীন কাঠকয়লার সুক্ষ্ম কনা সম্বলিত পদার্থ, যা ভমিটিং কিংবা লেভেজ প্রক্রিয়া অনুসরণের পর রোগীকে খাওয়ানো হয়। এটি পাকস্থলী কিংবা অন্ত্রে থাকা অবশিষ্ট ক্ষতিকারক পদার্থ (ঔষধ কিংবা কেমিক্যাল) শোষন করে এবং পরবর্তীতে পায়খানার সাথে বের হয়ে যায়। যার ফলে রক্তে ঐই ঔষধের উপস্থিতি কমে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাধারনত ৬০-১০০ গ্রাম এবং শিশুদের জন্য ১৫-৩৫ গ্রাম চারকোল খাওয়ানো হয়।
একই উদ্দেশ্যে কিছু বিরেচক ঔষধও (Cathartics) ব্যাবহার হয় যেমন, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, ম্যাগনেসিয়াম সাইট্রেট, সরবিটল ইত্যাদি।
- রেচন প্রক্রিয়া বাড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট সময় পরপর একাধিক ডোজে একটিভেটেড চারকোল খাওয়ানো বেশ কার্যকরী।
- তাছাড়া মূর্ত্রবর্ধক ঔষধ যেমন ক্লোরথায়াজাইড, ফুরোসেমাইড ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় যেন প্রস্রাবের সাথে পয়জন তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায়।
- প্রস্রাবের এসিডিটি (পিএইচ কমানো) বাড়ানোর মাধ্যমে ক্ষারীয় ড্রাগ, যেমন এমফিটামিন ও স্ট্রাইকনিনের বহিঃনিষ্কাশন বাড়ানো যায়। একইভাবে ক্ষারকত্ব বাড়ানোর (পিএইচ বাড়ানো) মাধ্যমে অম্লীয় ড্রাগ,যেমন স্যালিসাইলেট ও ফেনোবারবিটনের নিষ্কাশন বাড়ানো হয়।
অত্যাধিক বিষক্রীয়ায় আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে রক্ত থেকে দ্রুত টক্সিন দূর করার জন্য হসপিটালে হেমোডায়লাইসিস (Hemodialysis) ও হেমোপারফিউশন (Hemoperfusion) প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। ইথানল, আইসোপ্রোপানল, লিথিয়াম, থিওফাইলিন, স্যালিসাইলেট ইত্যাদি ড্রাগজনিত কারনে অত্যাধিক বিষ ক্রিয়ার ক্ষেত্রে হিমোডায়ালাইসিস বহুল প্রচলিত। আবার কিছু কিছু ড্রাগ আছে,যেমন মিথানল ও ইথিলিন গ্লাইকল যারা অত্যধিক মাত্রায় বিপাকের পর বিপদজনক পয়জনে রূপান্তর হয়। ঐসকল ড্রাগকে তাদের বিপাকের আগেই যদি অপসারন করা যায় তাহলে বিষক্রিয়া অনেকাংশেই পরিহার করা যায়। এসকল ক্ষেত্রে ডায়ালাইসিস উত্তপ্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী। তবে এই দুটি প্রক্রিয়া পরিচালনা করা বেশ ব্যয়বহুল ও সহজলভ্য নয়।
বাজারে কিছু কিছু নির্দিষ্ট পয়জনের বিপরীতে নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিডোট (Antidote) তথা প্রতিষেধক পাওয়া যায় যা বিষক্রিয়ার চিকিৎসার জন্য সর্বজনীন স্বীকৃত ঔষধ। এরা শরীরে শোষিত টক্সিনের প্রভাবকে প্রশমিত করার জন্য বিভিন্ন মেকানিজমে কাজ করে। উদাহরণসরূপ কিছু এন্টিডোট হচ্ছে, অর্গানোফসফেট জাতীয় কিটনাশকজনিত বিষক্রিয়ায় এট্রপিন এন্টিডোট (Atropine antidote), নাইট্রেট ও নাইট্রাইট এর জন্য মিথিলিন ব্লু (Methylene blue), অ্যাসিটামিনোফেন এর জন্য এন-অ্যাসিটাইলসিস্টিন (N-acetylcysteine) , সায়ানাইড বিষক্রিয়ার জন্য সোডিয়াম নাইট্রেট, আয়রন বিষক্রিয়ার জন্য ডিফেরোক্সামিন (Deferoxamine) এবং ভারী ধাতুজনিত বিষক্রিয়া যেমনঃ লেড,জিংক,কপার,ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদির জন্য ক্যালসিয়াম-ইডিটিএ কমপ্লেক্স (Calcium-EDTA complex) ব্যবহার করা হয়।
বিষক্রিয়া রোধে জনসাধারণের কিছু বিষয়ে সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত। যেমনঃ
- ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সঠিক সময়ে ঔষুধ গ্রহন করা, এই ক্ষেত্রে যথাযথ মাত্রায় ঔষধ খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- অস্পষ্ট লেভেলিং যুক্ত কোনো ঔষধ নিশ্চিত না হয়ে খাওয়া পরিহার করা।
- ঔষধ সমূহকে শিশুদের নাগালের বাহিরে উপযুক্ত পরিবেশে সংরক্ষিত রাখা।
- বাসা বাড়িতে প্রতিরক্ষা হিসেবে ইপিক্যাক সিরাপ রাখা যেন তৎক্ষনাৎ বিষক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ আনতে ব্যবহার করা যায়।
- ইপিক্যাক সিরাপ না থাকলে ঘরোয়া পদ্ধতিতে লবণ মেশানো গরম পানি, ডিমের সাদা অংশ কিংবা কাঁচা সরিষার তেল খাইওয়েও বমি করানো যেতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে বমি যেন শ্বাসনালীতে প্রবেশ না করে, সেজন্য রোগীর মাথা কিছুটা নিচের দিকে কাত করে রাখতে হবে।
খাবারে বিষক্রিয়া, অতিরিক্ত ঔষধ সেবনে বিষক্রিয়া ও আত্মহত্যার চেষ্টায় কীটনাশক বা হারপিক সেবনে বিষক্রিয়া বাংলাদেশে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এসকল পরিস্থিতিতে প্রাথমিকভাবে রোগীকে যত তাড়তাড়ি সম্ভব ইপিক্যাক সিরাপ খাইয়ে দিতে হবে। অতঃপর নিকটস্থ উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে।
তথ্যসূত্র:
১. GENERAL MANAGEMENT OF POISONED PATIENTS – ppt download [Internet]. Google.com. 2022 [cited 11 September 2022]. Available from: https://www.google.com/amp/s/ slideplayer.com/amp/5384646/
২. Gosselin RE, Smith RP, Hodge HC, Braddock JE. Clinical toxicology of commercial products. Baltimore: Williams & Wilkins; 1984 Sep.