বিষাক্ত পদার্থ সেবন করা রোগীর চিকিৎসায় ইপিক্যাক সিরাপ
/

বিষক্রিয়ার প্রাথমিক চিকিৎসায় ইপিক্যাক সিরাপ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত

638 বার পড়া হয়েছে

ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত বিষাক্ত পদার্থ সেবনে শরীরে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিতে পারে এবং এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে রোগীর চিকিৎসার অংশ হিসেবে সাধারণত রোগীকে বমি করানো হয়ে থাকে। বমি উদ্রেক করানোর জন্যে রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ইপিক্যাক সিরাপ ও দেয়া হয়।

বাংলাদেশে সাধারণত হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বারে ইপিক্যাক (ipecac) পাওয়া যায়। এটি ডাক্তারের সাথে আলোচনাপূর্বক ব্যবহার্য।

ইপিক্যাক সিরাপের গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতেই নিম্নের আলোচনার অবতারণা। তার পূর্বে জানার প্রয়োজন কি কি লক্ষণ দেখে আমরা বুঝব যে রোগী বিষক্রিয়ার আক্রান্ত।

বিষক্রিয়ার লক্ষণ

বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ বিভিন্ন উপসর্গ সৃষ্টি করে। বিষ আক্রান্তের প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ইপিক্যাক সিরাপ ব্যবহার করা হয়। বিষক্রিয়ার সাধারণ লক্ষণগুলি হল:

  • গুরুতর গলা ব্যথা
  • শ্বাস নিতে অসুবিধা
  • ঠোঁট বা মুখে পোড়াভাব
  • হঠাৎ আচরণের পরিবর্তন 
  • বমি বমি ভাব বা বমি 
  • জ্বর 
  • কোন কারন ছাড়াই পেটে ব্যথা অনুভব
  • খিঁচুনি বা অচেতনতা (শুধুমাত্র খুব গুরুতর ক্ষেত্রে)

ইপিক্যাক সিরাপ (Ipecac Syrup) কি?

ইপিক্যাক সিরাপ হল এক ধরনের এমেটিক বা বমি উদ্রেককারী ঔষধ, যা পাকস্থলীতে বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করার পূর্বেই বমির মাধ্যমে  শরীর থেকে বের হতে সাহায্য করে। বিষাক্ত পদার্থ সেবন করা রোগীকে সাথে সাথেই ইপিকেক সিরাপ খাওয়ানো হয়, যাতে করে খুব দ্রুতই  বিষাক্ত পদার্থটি বমির সাথে বের হয়ে যায়।

ইপিক্যাক পদার্থটি মূলত একটি ছোট গুল্ম  হতে প্রাপ্ত। গুল্মটির মূলের অংশটি মূলত সিরাপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মধ্য আমেরিকা এবং ব্রাজিলে এই গুল্মটি অধিক পরিমাণে উৎপাদিত হয়। ব্রাজিলে গুল্মটি Carapichea ipecacuanha নামে পরিচিত, যার শুকনো মূল থেকে সিরাপটি তৈরি করা হয়। ইপিক্যাক সিরাপ নন-প্রেসক্রিপশন পণ্য এবং প্রেসক্রিপশন পণ্য উভয়ভাবে পাওয়া যায়  কারণ এটি USFDA অনুমোদিত  পণ্য। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বা বেশি পরিমাণে ব্যবহার করলে ইপিক্যাক সিরাপ ব্যবহার করা ক্ষতিকর হতে পারে।

ইপিক্যাক নামক এই বমিউদ্রেককারী পদার্থটি  প্রধানত সিরাপ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। তবে ইপিক্যাক ফ্লুইড এক্সট্র্যাক্ট বা ইপিকেক টিংচার লেবেল করা বোতল দেখলে তা ব্যবহার করা করা যাবে না। কারণ এটি গুরুতর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বা কখনো কখনো মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।

রোগীর চিকিৎসায় শুধুমাত্র ইপিক্যাক সিরাপ সবচাইতে ভালো কাজ করে। এটি সবচেয়ে ভালো ফল দেয় যখন রোগীর পাকস্থলীতে খাবার থাকে।

ইপিক্যাক সিরাপের ডোজ

রোগীর বয়স, ওজন ইত্যাদি তারতম্যের কারণে ইপিক্যাক সিরাপের ডোজ  বিভিন্ন হয়। ঔষধের পরিমাণের ওপর তার প্রভাবও নির্ভর করে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ সিরাপ নেয়া যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনি অতিরিক্ত পরিমাণ এড়িয়ে চলাও অত্যাবশ্যক।

প্রাথমিকভাবে বয়সের প্রেক্ষিতে ইপিক্যাক এর ডোজ নির্ধারণ করা হয় কিন্তু আপনার জন্যে প্রয়োজনীয় ডোজটি একজন নিবন্ধিত চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিন।

  • প্রাপ্তবয়স্ক এবং কিশোর-কিশোরী – স্বাভাবিক ডোজ হল ১৫ থেকে ৩০ মিলিলিটার (১ থেকে ২ টেবিল চামচ), তারপরে অবিলম্বে একটি পানি পূর্ণ গ্লাস (২৪০ মিলি) নিতে হিবে। যদি বমি না হয় তবে ডোজটি বিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের পরে একবার পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে।
  • ১ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু– সাধারণ ডোজ ১৫ মিলি (১ টেবিল চামচ)। অর্ধপূর্ণ থেকে পরিপূর্ণ গ্লাস (১২০ থেকে ২৪০ মিলি)ডোজ আগে বা ঠিক পরে নেওয়া উচিত। যদি বমি না হয় তবে ডোজটি বিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের পরে একবার পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে।
  • ৬ মাস থেকে ১ বছর বয়সী শিশু– সাধারণ ডোজ ৫ থেকে ১০ মিলি (১ থেকে ২ চা চামচ)। অর্ধপূর্ণ থেকে পরিপূর্ণ গ্লাস (১২০ থেকে ২৪০ মিলি) ডোজ আগে বা ঠিক পরে নেওয়া উচিত। যদি বমি না হয় তবে ডোজটি বিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের পরে একবার পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে।
  • ০ থেকে ৬ মাস বয়সী বাচ্চা– ইপিকেক সিরাপ শুধুমাত্র ডাক্তারের নির্দেশে দেওয়া হয়। ইপিক্যাক সিরাপ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ১/২ এবং ১ আউন্স বোতলে পাওয়া যায়। তবে ১ আউন্স এর বেশী ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যাবহার করা উচিত নয়।

ইপিক্যাক সিরাপ সেবনে সতর্কতা

ইপিক্যাক সিরাপ সেবন করার পূর্বে কিছু অবস্থার বিবেচনা করা প্রয়োজন যা রোগীকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে তাই রোগীর অবস্থা সম্পর্কে চিকিৎসককে জানানো এবং সে অনুযায়ী পরামর্শ নেয়া অত্যাবশ্যক।

বিবেচনাযোগ্য অবস্থা গুলোর মধ্যে রয়েছে-

  • অ্যালার্জি: রোগীর কোন জিনিসের প্রতি এলার্জি যেমন খাবার, রঞ্জক, সংরক্ষণকারী বা প্রাণী, অবশ্যই  চিকিৎসক কে জানাতে হবে। সেজন্য যেকোনো  খাদ্যদ্রব্য লেবেল দেখে রোগীকে প্রেসক্রাইব করতে হবে।
  • হৃদরোগ: যে সকল রোগীর হৃদরোগ আছে তাদের ইপিকেক দেবার পর বমি না হলে অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত হৃদস্পন্দন দেখা দেয়, যা রোগীর জন্য জীবনের জন্য অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। এর ফলে রোগীর হৃদপেশীর অনেক ক্ষতি হতে পারে। এমনকি রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
  • অজ্ঞান বা খুব তন্দ্রাচ্ছন্ন ব্যক্তিদের এই ওষুধটি দেবেন না, কারণ বমি করা উপাদান ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে।
  • পেডিয়াট্রিক: শিশু এবং খুব ছোট বাচ্চাদের বমির সাথে দম বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খুব সতর্কতার সাথে এ ধরনের শিশুদের ইপিক্যাক সিরাপ দিতে হবে। ছোট বা ভীত শিশুর ক্ষেত্রে প্রথমে পানি দেওয়া যেতে পারে।
  • জেরিয়াট্রিক: এই ওষুধটি পরীক্ষা করা হয়েছে এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে এটি অল্প বয়স্কদের তুলনায় ভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা সমস্যা সৃষ্টি করে বলে দেখানো হয়নি।
  • শিশুকে স্তনপান করানো: স্তন্যপান করানোর সময় ইপিক্যাক সিরাপ শিশুর জন্য ন্যূনতম ঝুঁকি তৈরি করে।
  • ওষুধের মিথস্ক্রিয়া: কিছু ওষুধ  ইপিক্যাক সিরাপ এর সাথে একসাথে ব্যবহার করা উচিত নয়,  কারণ এতে সিরাপের কার্যকারিতা কমে যায় এবং মাঝে মাঝে ঔষধের মিথস্ক্রিয়ায়  বিভিন্ন শারীরিক জটিলতাও দেখা দিতে পারে। আপনি যদি অন্য কোনো প্রেসক্রিপশন বা অ-প্রেসক্রিপশন (ওভার-দ্য-কাউন্টার [OTC]) ওষুধ গ্রহণ করেন তা চিকিৎসককে অবগত করতে হবে।
  • অন্যান্য মিথস্ক্রিয়া: কিছু খাবার গ্রহণে সিরাপের সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে এবং সিরাপের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। ইপিক্যাক সিরাপ এর সাথে অ্যালকোহল বা তামাক ব্যবহার করলেও মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে। খাদ্য, অ্যালকোহল বা তামাকের সাথে আপনার ওষুধের ব্যবহার সম্পর্কে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
  • দুধ বা দুগ্ধজাত কোনো খাবারের সাথে ইপিক্যাক সিরাপ দেয়া যায় না। কারণ তা ঔষধের কার্যকারীতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
  • কার্বনেট জাতীয় খাদ্যদ্রব্য ইপিক্যাক এর সাথে দিলে পেট ফুলে যেতে পারে। তাই রোগীকে কার্বনেট জাতীয় পানীয় দেয়া যাবেনা।
  • অ্যাক্টিভেটেড চারকোল বমি বন্ধ হবার কাজ করে থাকে। তাই এটি ইপিক্যাক সিরাপ এর সাথে দেয়া যাবেনা। এতে করে ঔষধ এর কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। তাই ইপিক্যাক এর মাধ্যমে রোগীর বমি হবার পর অ্যাক্টিভেটেড চারকোল দেয়া হয়।

ইপিক্যাক সিরাপ সেবনে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া

রোগীকে ইপিক্যাক সিরাপ দেবার পর কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যা দেখা মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। সেগুলোর মধ্য রয়েছে –

  • ডায়রিয়া
  • অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
  • ত্রিশ মিনিটের বেশি সময় পর্যন্ত বমি বমি ভাব
  • খিঁচুনি
  • পেটে মোচড় দেয়া
  • শ্বাসকষ্ট
  • ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা
  • পেশীতে ব্যথা
  • স্টিফনেস (বিশেষ করে ঘাড়,পায়ে এবং বাহুতে)

এসকল লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে বা জরুরি সেবায় কল করতে হবে। পরিশেষে বলা যায়, ইপিক্যাক সিরাপ এমন একটি ঔষধ যা প্রতিটি ঘরে ঘরে থাকা উচিত।

আরও পড়তে পারেন

  • Drugs and Supplements Ipecac Syrup (Oral Route) [Internet]. Last updated 2021 Feb 1; cited 2022 Feb13. Available from here.
  • Olson KR, Anderson IB, Benowitz NL, Blanc PD, Clark RF, Kearney TE, Kim-Katz SY, Wu AH, editors. Poisoning & drug overdose. New York, NY, USA:: McGraw Hill Medical; 2012.

আমি তাসফিয়া ভূঁইয়া, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.ফার্মেসী (প্রফেশনাল) বিভাগের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী। নিয়মিত গবেষণাপত্র, ব্লগ পড়া এবং লেখালেখি করা আমার প্রথম পছন্দ। ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে স্বাস্থ্য ও ঔষধ বিষয়ক নিজের অর্জিত ক্ষুদ্র জ্ঞান তুলে ধরাই প্রধান লক্ষ্য। ভবিষ্যতে একজন ভালো ফার্মেসিস্ট ও গবেষক হতে চাই।

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.