High blood pressure explained in Bangla

উচ্চ রক্তচাপ — একটি নীরব ঘাতক

537 বার পড়া হয়েছে

বর্তমান সময়ে দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই কম-বেশি উচ্চ রক্তাচাপের সাথে পরিচিত। হাই ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপকে আমরা ইংরেজিতে হাইপারটেনশন (hypertension) বলে থাকি। এখন উচ্চ রক্তচাপ প্রায় প্রতিটি পরিবারের সাধারণ রোগ হয়ে দাড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। 

উচ্চ রক্তচাপে ভুগে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১০ থেকে ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। তাই আমাদের উচ্চ রক্তচাপ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা উচিত।

উচ্চ রক্তচাপ হলো এমন একটি রোগ যেখানে একজন মানুষের রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক হৃদপিণ্ড সংকোচন রক্তচাপ প্রায় ১২০ মিলিমিটার পারদচাপ (mmHg) এবং সম্প্রসারণ রক্তচাপ ৮০ মিলিমিটার পারদচাপ। এই মাত্রার চেয়ে বেশি রক্তচাপকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে গণ্য করা হয়।

উচ্চ রক্তচাপের শ্রেণীবিভাগ

ব্রিটিশ হাইপারটেনশন সোসাইটির তথ্যমতে উচ্চ রক্তচাপের শ্রেণীবিভাগ নিম্নে দেওয়া হল

বিভাগসংকোচন (সিস্টোলিক) রক্তচাপ (পারদচাপ) mmHgপ্রসারণ (ডায়াস্টোলিক) রক্তচাপ (পারদচাপ) mmHg
অনুকূল রক্তচাপ<১২০<৮০
স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০ – ১২৯<৮০ – ৮৪
উচ্চ রক্তচাপ (স্বাভাবিক)১৩০ – ১৩৯৮৫ – ৮৯
উচ্চ রক্তচাপ (পর্যায় ১)১৪০ – ১৫৯৯০ – ৯৯
উচ্চ রক্তচাপ (পর্যায় ২)১৬০ – ১৭৯১০০ – ১০৯
উচ্চ রক্তচাপ (পর্যায় ৩)>‌১৮০>‌১১০‌‌‌‌

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষ্মণসমূহ

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে যেগুলো অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এই লক্ষগুলো দেখে ধারণা করা যেতে পারে যে কোন রোগী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে কিনা। লক্ষণগুলো হলোঃ

  • গুরুতর মাথাব্যথা করা
  • মাথা গরম হয়ে যাওয়া
  • ঘাড় ব্যথা করা
  • নাক দিয়ে রক্ত ​​পড়া
  • তীব্র বুক ব্যথা করা
  • অনিয়মিত হৃদয়স্পন্দন
  • বুক ধড়ফড় করা
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
  • ক্লান্তি বা বিভ্রান্তি
  • দৃষ্টি সমস্যা
  • প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া
  • বুক, ঘাড় বা কানে ধাক্কার অনুভূতি 

আরও কিছু উপসর্গ রয়েছে যেগুলোকে সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়। তবে সেগুলো নাও হতে পারে। উপসর্গগুলো হলোঃ

  • মাথা ঘোরা
  • দুর্বলতা
  • অতিরিক্ত ঘাম ঝরা
  • ঘুমের সমস্যা
  • চেহারায় রক্তোচ্ছাস
  • চোখে রক্তের দাগ

উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলে আমরা ধারণা করতে পারি রোগী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। তবে নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না। কারণ লক্ষণগুলো অন্য কিছুর সাথে সম্পর্কিতও হতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপ নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন চিকিৎসকের নিকট গিয়ে রক্তচাপ পরিমাপ করা।

উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয়

উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের নিকট গেলে প্রথমেই তিনি রক্তচাপ নির্ণয় করে দেখবেন। রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্রের নাম স্ফিগমোম্যানোমিটার। এই যন্ত্র দিয়েই চিকিৎসকরা রক্তচাপ পরিমাপ করে থাকেন। বর্তমান সময়ে রক্তচাপ নির্ণয়ের ডিজিটাল মেশিন খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

উচ্চ রক্তচাপের কারণ

উচ্চ রক্তচাপ স্বাস্থ্যগত, অভ্যাসগত এবং পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলোঃ

  • বয়স

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। সাধারণত ৪০ বছরের বেশি বয়সের মানুষদের উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে।

  • বংশানুক্রমিক

পারিবারে কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকলে বংশানুক্রমিকভাবে তা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আসার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে।

  • অতিরিক্ত ওজন

অধিক ওজন সম্পন্ন মানুষদের ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বাড়তে থাকে। ফলে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা দেখা দেয়।

  • ধূমপান

ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে শরীরে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়।

  • অলস জীবন 

অলস জীবনযাপনের ক্ষেত্রে শারীরিক পরিশ্রমের প্রচণ্ড অভাব দেখা দেয়। তখন হৃদযন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।

  • ঘুমের সমস্যা 

সঠিকভাবে ঘুম না হলে আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।

  • মানসিক চাপ

দীর্ঘ সময় যাবৎ দুশ্চিন্তা, রাগ, উৎকন্ঠায় মানসিক চাপে থাকলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।

  • অতিরিক্ত মদ্যপান

যারা নিয়মিত মদ্যপান করে তাদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ বেশি দেখা দেয়। অ্যালকোহলে অতিরিক্ত পরিমাণে ক্যালরি থাকায় তা উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা ঘটায়।

  • অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ

লবণে সোডিয়াম থাকে যা রক্তের আয়তন বাড়িয়ে দেয়। তাই অতিরিক্ত ঘাম গ্রহণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।

  • চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ

চর্বিযুক্ত খাবার রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ধমনির দেয়ালকে মোটা করে ফেলে। ফলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।

  • ডায়াবেটিস 

ডায়াবেটিস রোগীদের ধমনি সংকীর্ণ হয় বেশি। ফলে বয়সের সাথে সাথে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।

  • কিডনী জটিলতা

কিডনী রক্ত থেকে বিষাক্ত পদার্থসমূহ ছেঁকে রক্তকে পরিশোধিত করার কাজ করে থাকে। কিডনিজনিত সমস্যা থাকলে রক্তের পরিশোধন বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।

  • ঔষধ গ্রহণ

কিছু কিছু ঔষধ আছে যেগুলো গ্রহণ করলে উচ্চ রক্তচাপ ঘটে। যেমমঃ গর্ভনিরোধক বড়ি, স্টেরয়েড, অ্যান্টিডিপ্রেশেন্ট ইত্যাদি।

উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা 

উচ্চ রক্তচাপের কারণে ধমনীর দেয়ালে অত্যধিক চাপ পড়ে যা রক্তনালীগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। রক্তচাপ যত বেশি এবং এটি যত বেশি সময় ধরে অনিয়ন্ত্রিত থাকবে তত বেশি ক্ষতি হবে। 

অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ যেসব জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে তার মধ্যে রয়েছেঃ

  • হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক

উচ্চ রক্তচাপ ধমনীগুলিকে শক্ত এবং মোট করে তোলে। যা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা অন্যান্য জটিলতার কারণ হতে পারে।

  • অ্যানিউরিজম (aneurysm)

বর্ধিত রক্তচাপ রক্তনালীগুলোকে দুর্বল করে দেয়। ফলে রক্তনালীগুলো ফুলে উঠে অ্যানিউরিজম গঠন করে।  যদি একটি অ্যানিউরিজম ফেটে যায় তবে এটি জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে।

  • হার্ট ফেইলিউর

শরীরে উচ্চ চাপের বিরুদ্ধে রক্ত ​​পাম্প করতে হৃৎপিণ্ডকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ফলে হার্টের পাম্পিং প্রকোষ্ঠের দেয়াল মোটা হয়ে যায়। এই মোটা হয়ে যাওয়া পেশীর পক্ষে শরীরের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট রক্ত ​​পাম্প করা কষ্টকর হয়ে পড়ে, তখন হার্ট ফেইলিওর ঘটে।

  • দৃষ্টি সমস্যা 

উচ্চ রক্তচাপের কারণে চোখের মধ্যে ঘন এবং সরু রক্তনালীগুলো ছিড়ে যেতে পারে। ফলে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

  •  বিপাকীয় সমস্যা

উচ্চ রক্তচাপের কারণে জটিল বিপাকীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে যা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি করে তোলে।

  • স্মৃতিলোপ বা বোঝার সমস্যা

অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ চিন্তা করার, মনে রাখার এবং শেখার ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।  উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি বা ধারণা বোঝার সমস্যা বেশি দেখা যায়।

  • ডিমেনশিয়া (dementia)

উচ্চ রক্তচাপের ফলে সৃষ্টি হওয়া সংকীর্ণ বা অবরুদ্ধ ধমনী মস্তিষ্কে রক্ত ​​​​প্রবাহ সীমিত করতে পারে, যা একটি নির্দিষ্ট ধরণের ডিমেনশিয়া (ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া)।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে করণীয়

  • অতিরিক্ত ওজন কমানো
  • শারীরিক পরিশ্রম করা
  • ধূমপান ত্যাগ করা
  • অতিরিক্ত মদ্যপান ত্যাগ করা
  • অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা না করা
  • পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা
  • অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ না করা
  • চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ না করা
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি গ্রহণ
  • নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা 
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষধ গ্রহণ

পরিশেষে, বর্তমান সময়ে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা খুব বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি। যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ এখনো জানেই না যে তারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। আবার যারা জানে তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষ উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে। এই সমস্যা সমাধানে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন। নতুবা এই নীরব ঘাতক অজান্তেই আমাদের এবং আমাদের প্রিয়জনদের প্রাণ নাশ করে দিতে পারে।

তথ্যসূত্র

1. Dyker AG. Hypertension. In Walker R. & Whittlesea C. Clinical Pharmacy and Therapeutics. 5th edition. Toronto: Elsevier publishing; 2012. page 295-311.

আমি হৃদয় কুমার ঘোষ। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী বিভাগে পঞ্চম বর্ষে অধ্যয়নরত। নিজের মনের অভিব্যক্তিগুলোকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করার জন্যই মূলত লেখালেখিতে হাতেখড়ি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহও সবসময়ই ছিল। নিজের জানাকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও লেখার চেষ্টা করতাম।

তাছাড়া একজন বিতার্কিক হিসেবে যেকোনো বিষয়কে যুক্তিসঙ্গতভাবে গুছিয়ে উপস্থাপনের যে চর্চা তা আমার লেখালেখিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে আমি মনে করি। একটা কিছু লেখার পরে বার বার পড়ি আর ভাবতে থাকি, কিভাবে লেখাটাকে আরও সহজ, সুন্দর এবং সাবলীলভাবে পাঠকের নিকট উপস্থাপন করা যায়। এটা করতে গিয়ে আমি কখনোই বিরক্তবোধ করি না বরং আমার ভালো লাগে। আর ভালো লাগার জায়গায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে আমি কখনোই কার্পণ্য করি না।

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.