Drug Safety in Pregnancy
///

গর্ভাবস্থায় সুরক্ষা — অনিরাপদ ওষুধ সেবন পরিহার ও সর্তকতা

437 বার পড়া হয়েছে

গর্ভাবস্থায় নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে থাকে। এসময় গর্ভবতী মা ও গর্ভের সন্তান উভয়ের স্বাস্থ্যঝুঁকির হার অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ অবস্থায় একজন গর্ভবতী নারীকে স্বাস্থ্য সচেতনতার পাশাপাশি ঔষধ সেবনেও সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। মনে রাখা জরুরি যে, সামান্য একটু অবহেলা ও অসচেতনতা গর্ভবতী মায়ের ও গর্ভের বাচ্চার স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় যেকোনো ঔষধ গ্রহনের আগে একজন চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি কারণ কিছু কিছু ক্ষতিকর কিংবা অনিরাপদ ওষুধ সেবন গর্ভবতী মায়ের গর্ভের সন্তানের বেড়ে ওঠায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি অনিরাপদ ওষুধ অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে সৃষ্টি হতে পারে গর্ভপাত (miscarriage) কিংবা গর্ভের সন্তানের শারীরিক বিকলাঙ্গতার (physical malformation) মতো মারাত্মক জটিলতা।

আরও পড়ুন

কীভাবে ওষুধ ভ্রূণকে প্রভাবিত করে

কজন গর্ভবতী নারী যে ঔষধগুলো গ্রহণ করেন তা বিভিন্ন উপায়ে ভ্রূণকে (fetus) প্রভাবিত করতে পারে। এ সময় কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ঔষধ ভ্রূণের উপর সরাসরি কাজ করে জন্মগত ত্রুটিসহ গর্ভের সন্তানের মৃত্যুও ঘটাতে পারে। এসকল ঔষধ সাধারণত রক্তনালীগুলিকে সংকুচিত করে দেয়, ফলে মায়ের থেকে ভ্রূণে অক্সিজেন (oxygen) ও পুষ্টি (nutrition)  সরবরাহ কমে যায় এবং এরই ফলশ্রুতিতে প্লাসেন্টার (placenta) কার্যকারিতাও পরিবর্তিত হয়ে যায়, যা গর্ভের সন্তানের শারীরিক বিকলাঙ্গতার কিংবা জন্মগত ত্রুটি মতো মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করে।

গর্ভাবস্থায় ওটিসি (Over the Counter – OTC) ও ব্যথানাশক ওষুধ সেবনে ঝুঁকিসমূহ

অ্যাসপিরিন (Aspirin):

জ্বর-ঠাণ্ডা, ব্যাথা, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (cardiac arrest), স্ট্রোকের ঝুঁকি, রিউম্যাটয়েড (rheumatoid) এবং অন্যান্য চিকিৎসার জন্য ‘অ্যাসপিরিন’ ঔষধ বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এ ঔষধ সেবন গর্ভের সন্তানের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাসপিরিন গর্ভধারণের প্রথম কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। সেই সাথে অ্যাসপিরিন প্লাসেন্টা অ্যাবরাপশন’য়ের (placental abruption) মতো স্বাস্থ্যঝুঁকিও বৃদ্ধি করে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গর্ভাবস্থায় কখনো অ্যাসপিরিন সেবন করা যাবে না।

প্যারাসিটামল (Paracetamol):

গর্ভাবস্থায় জ্বর কিংবা মাথা ও শারিরীক ব্যথায় প্যারাসিটামল বা এসিটামিনোফেন (acetaminophen) ব্যবহারের ফলে সাময়িক উপশম হলেও তা গর্ভের সন্তানের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে ফেলতে পারে।

আমেরিকার একদল গবেষক তাদের গবেষণায় জানিয়েছেন, গর্ভকালীন প্রথম তিনমাসে প্যারাসিটামল সেবনের ফলে গর্ভের সন্তানের কথা শেখার সম্ভাবনা স্বাভাবিক সন্তানের তুলনায় ৬ গুন কমে যায়। এছাড়াও গর্ভকালীন তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (third trimester)  প্যারাসিটামল ব্যবহারের ফলে প্রজনন এবং ইউরোজেনিটাল ব্যাধি (urogenital disorder) গুলির ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen):

আইবুপ্রোফেন জ্বর,  দাঁত ব্যথা, মাথা ও পেশী ব্যথা, বাত, জয়েন্ট ব্যথা, পিঠব্যথা এবং অন্যান্য অবস্থার চিকিৎসায় ব্যবহৃত  হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় আইবুপ্রোফেন সেবন নিরাপদ হলেও গর্ভবতী নারীর জন্য এই ওষুধ অনিরাপদ । 

উচ্চ মাত্রায় আইবুপ্রোফেন ব্যবহার অনেক গর্ভবতী নারীদের গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। 

উচ্চ মাত্রায় আইবুপ্রোফেন ব্যবহারের ফলে- গর্ভপাতের ঝুঁকির হার বৃদ্ধি পায়, প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়, ভ্রূণের ডাক্টাস আর্টেরিওসাস (ductus arteriosus) এর ফলে ধমনী (artery) অকাল বন্ধ হয়ে যেতে পারে, নেক্রোটাইজিং এন্টারোকোলাইটিস (necrotizing enterocolitis) বা অন্ত্রের আস্তরণের ক্ষতি হতে পারে কিংবা ভ্রূণের কার্নিক্টেরাস (kernicterus) এর মতো বিশেষ এক ধরনের  মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। 

গর্ভকালীন সময়ে প্রাইমাকুইন, ওয়ারফেরিন, গুয়াইফেনাসেন ব্যবহারে বিধিনিষেধ

প্রাইমাকুইন (Primaquine): প্রাইমাকুইন ঔষধটি ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।  প্রাইমাকুইন গর্ভাবস্থায় সেবন করা নিরাপদ নয়, কারণ যেসব গর্ভবতী নারীদের গ্লুকোজ-৬-ফসফেট ডিহাইড্রোজেনেস  এর ঘাটতি রয়েছে, সে সকল নারীদের গর্ভাবস্থায় প্রাইমাকুইন সেবনের ফলে ভ্রূণের হিমোলাইসিস (Fetal hemolysis) অর্থাৎ রক্ত ​​​​কোষের ক্ষতির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ওয়ারফেরিন (Warfarin): ওয়ারফেরিন এক ধরনের ঔষধ, যা অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট (Anti coagulant)  হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গর্ভাবস্থায় এটি ভ্রূণের অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের (Fetal internal bleeding)  সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে  গর্ভপাতের ঝুঁকি বা জন্মগত ত্রুটি  (Congenital error) হার বহুগুণ বেড়ে যায়।

গুয়াইফেনেসিন (Guaifenesin): জ্বর, সর্দি বা কাশির ঔষধের একটি সাধারণ উপাদান হিসেবে ‘গুয়াইফেনাসেন’ ব্যবহার করা হয়।  গর্ভবতী নারী  ‘গুয়াইফেনাসেন’ ব্যবহারের ফলে গর্ভের সন্তানের মাঝে বিভিন্ন ধরনের জন্মগত সমস্যার তৈরি করতে পারে। 

গর্ভাবস্থায় মানসিক উপশমকারী ঔষধ সেবনে স্বাস্থ্যঝুঁকি

লিথিয়াম পিল (Lithium pill): গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী নারী সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে মানসিক অস্বস্তি ও কখনো কখনো  অনেক বেশি হতাশাগ্রস্ততা হয়ে পরে। তখন  মানসিক অস্বস্তি কিংবা ‘বাইপোলার ডিজঅর্ডার’ (bipolar disorder) থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ‘লিথিয়াম পিলস’ সেবন করে থাকে।  এই ঔষধসেবনে গর্ভের বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। 

লোরাজেপাম (Lorazepam) ও ক্লোনাজেপাম (Clonazepam): মাদকদ্রব্য বা অ্যালকোহল (Alcohol)  চিকিৎসায় এই দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এরা বেনজোডায়াজেপাইন (Benzodiazepine)  গ্রুপের সদস্য, যা মস্তিষ্কের গাবা রিসেপটর (GABA receptor) গুলির উপর কাজ করে। এই ধরনের ওষুধ গর্ভাবস্থায় ব্যবহারের ফলে গর্ভের সন্তানের মাঝে ‘উইড্রয়াল সিম্পটোম’ (withdrawal symptom) দেখা যায় এবং জন্মের পরে এ ধরণের ওষুধের  সেবনের ফলে নবজাতক শিশুর মধ্যে জন্মগত ত্রুটিও দেখা যেতে পারে।

কোডাইন (Codeine): কোডাইন হল একটি ওপিওড (opioid) সদস্যের ড্রাগ যা ব্যথার উপশম (pain reliever)  করতে ব্যবহৃত হয়।  গর্ভাবস্থায় কোডাইন ড্রাগ মা হতে প্লাসেন্টায় অতিক্রম করে। তাই  প্রসবের সময় এই ওষুধের ব্যবহার নবজাতক শিশুর শ্বাসকষ্টের (Shortness of breath) কারণ হতে পারে। এমনকি গর্ভাবস্থায় কোডাইনের দীর্ঘায়িত ব্যবহারের ফলে জন্মের পরপরই নবজাতক শিশুর ‘উইড্রয়াল সিম্পটোমের’ (withdrawal symptom) সমস্যার সৃষ্টি হয়।

গর্ভাবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotic) ব্যবহারে স্বাস্থ্য সচেতনতা

ক্লোরামফেনিকল (Chloramphenicol): ক্লোরামফেনিকল একটি অ্যান্টিবায়োটিক, যা সাধারণত ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। তবে মৌখিক পথে (Oral route) এই ওষুধটি ব্যবহারে সর্তকতা অবলম্বন করা জরুরি, কারণ ওরাল ক্লোরামফেনিকল প্লাসেন্টা অতিক্রম করতে পারে। এ ওষুধের ব্যবহারের ফলে নবজাতকের গুরুতর রক্তের ব্যাধি (severe blood disorder) এবং ‘গ্রে বেবি সিন্ড্রোমের’ (Gray baby syndrome)  মতো জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।

সিপ্রোফ্লক্সাসিন (Ciprofloxacin) এবং লেভোফ্লক্সাসিন (Levofloxacin):  এ ধরনের  অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও গর্ভবতী নারীদের সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এই ঔষধগুলি শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে, শিশুর পেশী এবং জয়েন্টে ব্যথার (Joint pain) মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

ফ্লুরোকুইনোলন (Fluoroquinolone):   ফ্লুরোকুইনোলন এক প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক, গর্ভাবস্থায় এই অ্যান্টিবায়োটিকটি  সতর্কতার সাথে  ব্যবহার করতে হবে। এটির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, মহাধমনী (Aorta) ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।  এর ফলে কখনো কখনো প্রাণঘাতী রক্তপাতও (Fatal bleeding) হতে পারে। যা গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয় এবং যেসব গর্ভবতী নারীদের  ‘অ্যানিউরিজম’ (aneurysm) ইতিহাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ফ্লুরোকুইনোলন ব্যবহারের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার (side effects) ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

সালফোনামাইড (Sulfonamide): এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো সালফা ড্রাগ হিসাবে পাওয়া যায়। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে সালফোনামাইড ওষুধ সেবন করা অনিরাপদ কারণ এই ওষুধগুলি নবজাতকের মধ্যে প্রোটিন-বাইন্ডিং সাইট (Protein binding site) থেকে বিলিরুবিনকে (Bilirubin) সরিয়ে দেয়, যার ফলে নবজাতকের জন্ডিস দেখা দিতে পারে।

ট্রাইমেথোপ্রিম (Trimethoprim): ট্রাইমেথোপ্রিমও এক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। ট্রাইমেথোপ্রিম গর্ভাবস্থায় নেওয়া যেতে পারে, তবে প্রথম ১২ সপ্তাহে এটি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়, কারণ এটি ফলিক এসিডের (Folic acid) মাত্রাকে প্রভাবিত (affect) করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে ফলিক এসিড অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। গর্ভাবস্থায় এই ওষুধটি নেওয়া হলে, শিশুর নিউরাল টিউবের (Neural tube) ত্রুটিও সৃষ্টি হতে পারে।  

পরিশেষে, গর্ভবতী নারীরা গর্ভাবস্থায় খুব সহজেই রোগাক্রান্ত হতে পারে, কারণ এই সময় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশে কমে যায়। তাই রোগ নিরাময়ে যেকোনো ওষুধ সেবনের আগে যথাসম্ভব সর্তক থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ভাবেই এসকল স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ সেবন করা যাবে না।  এ সময় নিয়মিত স্বাস্থ্য চেকআপ ও গর্ভকালীন সর্তকতা মা ও গর্ভের সন্তানের মৃত্যুঝুঁকিকে কমিয়ে দেয়। মনে রাখতে হবে যে, একজন সুস্থ গর্ভবতী মা-ই কেবল তার গর্ভকালীন চ্যালেঞ্জকে কাটিয়ে, সুন্দর ও স্বাভাবিক নবজাতক জন্মদানে  সক্ষম।

References:

1. Briggs GG, Freeman RK, Yaffe SJ (eds) (2008). Drugs in Pregnancy and Lactation, 8th ed. Philadelphia: Lippincott Williams and Wilkins.

2. Anitha B, Malavika S, Kumar B (November 2018). Current trends in drugs avoided in pregnancy. Journal of Drug Delivery and Therapeutics; 8(6):342-350

3. Sebastiani G, Borrás-Novell C, Alsina M, Tutusaus MP, Ferrero S, Gómez-Roig D, Garcia-Algar O (August 2018). The Effects of Alcohol and Drugs of Abuse on Maternal Nutritional Profile during Pregnancy; Nutrients 10(8):1008

আমি মোঃ সালাহ উদ্দিন রবিন, ব্যাচেলর ইন ফার্মেসি (প্রফেশনাল) কোর্সের পঞ্চম বর্ষে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছি। ফার্মেসি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি জানি অনিরাপদ এবং অনিয়ন্ত্রিত ঔষধ সেবনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও এর স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়াবহতা। তাই অনলাইন প্লাটফর্মে লেখালেখির মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ক নিজের অর্জিত ক্ষুদ্র জ্ঞানকে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ছড়িয়ে দিতে চাই। পাশাপাশি ভবিষ্যতে গবেষণামূলক বিভিন্ন কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাই।

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.