মেটফরমিন হচ্ছে বাইগুয়ানাইড ড্রাগ যা আমাদের রক্তের শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। মেটফরমিন প্রথম সারির অ্যান্টিডায়াবেটিক ঔষধ যা সাধারণত টাইপ – ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়। ডায়াবেটিস হচ্ছে এক ধরনের বিপাকীয় ব্যাধি যেখানে আমাদের শরীর তার রক্তের শর্করা কে সঠিকভাবে বিপাক করতে পারে না, যার ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
এই ওয়েবসাইটে আরো পড়ুন –
- ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় পেশেন্ট এজুকেশন
- ডায়াবেটিসে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করা কেন জরুরি!
- ডায়াবেটিস কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন?
- বাংলাদেশে টাইপ- ২ ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় পেশেন্ট কমপ্লায়েন্সের গুরুত্ব
সাধারণত মেটফরমিনকে ট্যাবলেট (৫০০ মি.গ্রা., ৮৫০ মি.গ্রা., ১০০০ মি.গ্রা.) এবং সিরাপ আকারে বাজারে পাওয়া যায়। কখনো কখনো মেটফরমিনকে ইনসুলিন ও অন্যান্য এন্টি ডায়াবেটিক ঔষধের সাথে ব্যবহার করা হয় যাতে করে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও মেটফরমিনকে পলিসিসটিক ওভারি সিনড্রোম (polycystic ovary syndrome) প্রতিকারের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু গর্ভবতী মহিলা এবং যারা তাদের সন্তানদের বুকের দুধ পান করান এবং ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের মেটফরমিন গ্রহণে উৎসাহিত করা হয় না।
মেটফরমিন এর কর্মপ্রক্রিয়া
মেটফরমিন কোষের শক্তি বিপাক প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করার মাধ্যমে রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মেটফরমিন বিভিন্ন উপায়ে বিপাক প্রক্রিয়া পরিবর্তন আনয়ন করে। প্রক্রিয়াগুলো নিম্নরূপ:
- শর্করার মাত্রা হ্রাস করা: মেটফরমিন শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়ায় না কিন্তু চিনি উৎপাদন হ্রাস করার মাধ্যমে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে। ইহা সাধারণত যকৃতে গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ার হার কমিয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। তাছাড়া ইহা অগ্নাশয়কে গ্লুকাগন (glucagon) নিঃসরণে বাধা প্রদান করে। [Gluconeogenesis: এই প্রক্রিয়ায় যকৃত নন-কার্বোহাইড্রেট উৎস থেকে শর্করা তৈরি করে। Glucagon: ইহা রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করে।]
- ইনসুলিন সংবেদনকারী এজেন্ট (Insulin Sensitizing Agent): মেটফরমিন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমাতে সাহায্য করে। ইনসুলিন এক ধরনের প্যানক্রিয়েটিক হরমোন যা রক্তে শর্করাকে কোষে পাঠিয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে আনে। যখন আমাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করা বিপাক করতে পারে না এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, এটাই ইনসুলিন রেজিস্টেন্স নামে পরিচিত। যার ফলে ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ হয়ে থাকে।
- সুগার শোষণ কমানো: মেটফরমিন ক্ষুদ্রান্তে সুগারের শোষণ কমিয়ে রক্তে সুগারের মাত্রা কম রাখতে সহায়তা করে। [ক্ষুদ্রান্ত: ইহা মাধ্যমে পরিপাককৃত খাদ্যসার শোষিত হয়।]
মেটফরমিন ব্যবহার
মেটফরমিন খুবই যুগান্তকারী ঔষধ যাহা শুধু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ নয়, ওজন কমাতেও সহায়তা করে। মেটফরমিন এর ব্যবহার নিম্নরূপ বর্ণনা করা হলো:-
- মেটফরমিন এর প্রধান ব্যবহার হলো এন্টি-ডায়াবেটিক মেডিসিন হিসেবে কারণ ইহা রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়।
- মেটফর্মিন লিপিড লোয়ারিং এজেন্ট (lipid lowering agent) হিসেবেও কাজ করে। ইহা লিপিডের বিপাক বৃদ্ধি করার মাধ্যমে রক্তে লিপিডের মাত্রা কমিয়ে আনে।
- পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (polycystic ovary syndrome) চিকিৎসায়ও এর ব্যবহার রয়েছে।
- যেহেতু মেটফরমিন রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা কমিয়ে আনে তাই ইহাকে হৃদরোগ প্রতিরোধেও ব্যবহার করা হয়।
- এন্টি-টিউমার এজেন্ট (antitumor agent); ইহা কোষের অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন বন্ধ করার মাধ্যমে মাধ্যমে টিউমারের বৃদ্ধি কমায়।
- ওজন কমানো; মেটফরমিন পরিপাককৃত খাদ্যসারের শোষণ কমানোর মাধ্যমে ওজন কমাতে সহায়তা করে।
মেটফরমিন খাওয়ার নিয়ম
চিকিৎসার প্রথম কয়েক সপ্তাহে পেট বা অন্ত্রের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে খাওয়ার পর ভরা পেটে মেটফরমিন গ্রহণ করা ভালো। পর্যাপ্ত পানি দিয়ে পুরো বড়িটি গিলে ফেলুন। এটি চূর্ণ, ভাঙ্গা বা চিবিয়ে ফেলবেন না। মেটফরমিন অ্যালকোহল ও আঙ্গুরের সাথে সেবন পরিহার করুন।
ডায়াবেটিক হিসেবে আপনার ডাক্তার আপনাকে যে বিশেষ খাবারের পরিকল্পনা দিয়েছেন তা অনুসরণ করুন। এটি আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং ওষুধটি সঠিকভাবে কাজ করতে হলেও প্রয়োজনীয়। নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং ওষুধের প্যাকেটে থাকা ওষুধের তথ্যগুলো পড়ে নিতে পারেন।
মেটফরমিন এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
- মাথাব্যথা (Headache)
- মাথা ঘোরা (Dizziness)
- পেশি দুর্বলতা (Muscle weakness)
- বমি ভাব (Nausea )
- অনিয়মিত হার্টবিট (Irregular heartbeat)
- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (Arrhythmia)
- পেট ব্যথা (Abdominal pain)
- দুর্বলতা (Weakness)
- বুকে অস্বস্তি (Discomfort in chest)
- ঢেকুর (Belching)
মেটফরমিন এর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
হাইপোগ্লাইসেমিয়া (Hypoglycemia)
হাইপোগ্লাইসেমিয়া এক ধরনের মারাত্মক বিপাকীয় অবস্থা, যেখানে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায় এবং মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে। অ্যান্টি ডায়াবেটিক ড্রাগসমূহের একটি সাধারন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো হাইপোগ্লাইসেমিয়া। হাইপোগ্লাইসেমিয়া লক্ষণ সমূহ নিম্নরূপঃ
- হাত-পা কাপা
- মাথা ঘোরা
- ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া
- দ্রুত হৃৎকম্পন
- মনোযোগের ব্যর্থতা
- খিটখিটে মেজাজ
ল্যাকটিক এসিডোসিস (Lactic acidosis)
ল্যাকটিক এসিডোসিস হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যেখানে রক্তে ল্যাকটিক এসিডের পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়, যার ফলে রক্তের পিএইচ (pH) কমে পায়। আমাদের দেহের কোষ সমূহ যখন সবাত শ্বসন প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয় তখন তারা বাইপাস হিসেবে অবাত শ্বসন প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজের আংশিক ভাঙ্গনের মাধ্যমে অল্প পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করে। অবাত শ্বসন প্রক্রিয়ায় উপজাত হিসেবে ল্যাকটিক এসিড উৎপন্ন হয় এবং রক্তে ল্যাকটিক এসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ল্যাকটিক এসিডোসিস হয়।
অসংলগ্ন কিডনি কার্যকলাপ (Impaired renal function)
মেটফরমিন স্বাভাবিক কিডনির কার্যক্রমে বাধা প্রদান করে। দীর্ঘদিন মেটফরমিন এর ব্যবহার কিডনি ফেইলিওর (Failure) ত্বরান্বিত করে।
এলার্জি (Allergy)
কিছু ডায়াবেটিক পেশেন্টের দেহে মেটফর্মিন এলার্জির তৈরি করে, ইহা মেটফরমিন এলার্জি (Metformin allergy) নামে পরিচিত। যেসকল পেশেন্ট মেটফরমিন এর প্রতি এলার্জি প্রদর্শন করে তাদেরকে মেটফরমিন সেবন থেকে বিরত করা হয়। মেটফরমিন এলার্জি (Metformin allergy) এর লক্ষণসমূহ-
- হাত-পা কাপা
- মাথা ঘোরা
- ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া
- দ্রুত হৃৎকম্পন
- মনোযোগের ব্যর্থতা
- খিটখিটে মেজাজ
মেটাবলিক এসিডোসিস (Metabolic acidosis)
মেটাবলিক এসিডোসিস মারাত্মক ইলেক্ট্রোলাইট ডিজঅর্ডার (Electrolyte disorder) যেখানে এসিড ও ক্ষারের ভারসাম্য নষ্ট হয়, ফলে রক্তের পিএইচ ৭.৪ থেকে কমে যায় । মেটাবলিক এসিডোসিস প্রধানত তিনটি কারণে হয়ে থাকে-
- এসিডের উৎপাদন বেড়ে যাওয়া
- বাই কার্বনেট এর উৎপাদন কমে যাওয়া
- কিডনি ফেইলিওর
ঔষধের মিথষ্ক্রিয়া (Metformin Drug Interactions)
যখন মেটফরমিন ও একাধিক ওষুধ অথবা অ্যালকোহল একসাথে সেবন করা হয়। তখন মেটফরমিন ও অন্যান্য ঔষধ বা পানীয় পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে। এর ফলে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো এড়াতে আমরা নিম্নোক্ত ঔষধগুলো এবং পানীয়কে একসাথে সেবন করা থেকে বিরত থাকবো।
অ্যালকোহল
মেটফরমিন অ্যালকোহল একসাথে গ্রহণ করলে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যেমন: দুর্বলতা, মাংসপেশিতে ব্যথা, ঘুমের অভাব, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা। শ্বাস- প্রশ্বাসজনিত সমস্যা হলে দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। তাছাড়াও অ্যালকোহল ও মেটফরমিন একসাথে গ্রহণ করলে ক্ষুদ্রান্তে ভিটামিন বি-১২ (Vitamin B12) এর শোষণ হ্রাস পায় এবং ল্যাকটিক এসিডোসিস এর ঝুঁকি বাড়ায়।
গ্যাটিফ্লক্সাসিন
Gatifloxacin হচ্ছে এন্টিবায়োটিক ড্রাগ। ইহা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে। গ্যাটিফ্লক্সাসিন ও মেটফরমিন একসাথে সেবন করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়াসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এম্লডিপিন
Amlodipine, মেটফরমিন এর হাইপোগ্লাইসেমিক প্রভাব কমানোর মাধ্যমে এর কার্য প্রক্রিয়া কে প্রভাবিত করে। এ কারণে এম্লডিপিন ও মেটফরমিন একসাথে নেওয়া উচিত নয়।
এস্ট্রাডাইওল
Estradiol মেটফরমিন এর কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয়। যার ফলে মেটফর্মিন কার্যকরভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যদি আমরা এস্ট্রাডাইওল এবং মেটফরমিন কে একসাথে নেই তাহলে মেটফরমিন এর ডোজ বাড়িয়ে নিতে হয়।
যেসব ক্ষেত্রে মেটফরমিন নেওয়া যাবে না
নিম্মোক্ত অবস্থায় মেটফর্মিন নেওয়া যাবে না-
- মেটফরমিন এর প্রতি যাদের এলার্জি রয়েছে তাদেরকে মেটফরমিন প্রেসক্রাইব করা যাবে না।
- যেকোনো ধরনের বিপাকীয় এসিডোসিস যেমন ল্যাকটিক এসিডোসিস (শরীরে ল্যাকটেট এর পরিমাণ বৃদ্ধি), ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস (রক্তে কিটোনবডির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া)।
- ক্রনিক হার্ট ফেইলিওর
- অসংলগ্ন কিডনি কার্যকলাপ
- মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (myocardial infarction): ইহা এমন একটা অবস্থানে যেখানে হৃদপেশী গুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়।
- গর্ভাবস্থা
সতর্কতা
যখন রোগী নিম্নোক্ত লক্ষণ ও উপসর্গগুলো প্রদর্শন করবে তখন আমাদের মেটফরমিন ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে।
- কনজেসটিভ হার্ট ফেইলিওর (congestive heart failure)
- জ্বর
- মানসিক আঘাত
- অসংলগ্ন কিডনি ফাংশন
- যকৃতের ব্যাধি
সে যাই হোক, মেটফরমিন খুবই মূল্যবান এন্টি ডায়াবেটিক ড্রাগ যা অত্যন্ত কার্যকরভাবে রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া, ইহার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তুলনামূলক কম হওয়ায় এটি বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তথ্যসূত্র
- Sanjid Shaha: “Metformin”: Drug. Com: 2021 Apr 28.
- Dunn CJ, Peters DH (May 1995). “Metformin. A review of its pharmacological properties and therapeutic use in non-insulin-dependent diabetes mellitus”. Drugs. 49 (5): 721–49.
- Bailey CJ, Turner RC (February 1996). “Metformin”. The New England Journal of Medicine. 334 (9): 574–9.
- Pietraszek A, Gregersen S, Hermansen K. Alcohol and type 2 diabetes. A review. Nutr Metab Cardiovasc Dis (2010) 20(5):366–75.
সর্বশেষ হালনাগাদঃ জানুয়ারি ৬, ২০২৪