দীর্ঘকালীন কর্টিকোস্টেরয়েড (corticosteroids) ব্যবহারে কেন সতর্ক হওয়া উচিত!
/

দীর্ঘকালীন কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারে কেন সতর্ক হওয়া উচিত!

652 বার পড়া হয়েছে

এলার্জি সমস্যায় অনেকেই Cortan (Incepta Pharmaceuticals), Inflagic (Square Pharmaceuticals) ট্যাবলেট কিংবা চর্মরোগের জন্য Fortison (Incepta Pharmaceuticals), Topicort (Square Pharmaceuticals) মলম ব্যবহার করে থাকেন।

এই ঔষধগুলো মূলত বিভিন্ন কর্টিকোস্টেরয়েড, যা বিভিন্ন ধরনের এলার্জি, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন সমস্যায় ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন রোগের প্রতিকারক হিসেবে কর্টিকোস্টেরয়েডস (corticosteroids) কাজ করলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেহাত কম নয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা যেতে পারে, যা মাঝে মাঝে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। তাই কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের পূর্বে এর সুবিধা এবং ঝুঁকিসমূহ অবশ্যই বিবেচনা করে নিতে হবে।

কর্টিকোস্টেরয়েডস কি এবং কেন ব্যবহৃত হয়/ What are Corticosteroids?

কর্টিকোস্টেরয়েড হচ্ছে এক ধরনের হরমোন যা বৃক্ক/ কিডনিতে (এড্রিনাল কর্টেক্সে) তৈরি হয় এবং এটি দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, রক্তে আয়নের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ, শর্করা বিপাকসহ বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া সাথে জড়িত। বিভিন্ন ঔষধে ব্যবহৃত কর্টিকোস্টেরয়েডগুলো দেহের কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোনের (মূলত cortisol) অনুরূপ কাজ করে। ঔষধে ব্যবহৃত কর্টিকোস্টেরয়েড এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডেক্সামিথাসন (Dexamethasone), প্রেডনিসোল (Prednisone), মিথাইলপ্রেডনিসোলন (Methylprednisolone), হাইড্রোকর্টিসন (Hydrocortisone) ইত্যাদি। 

কর্টিকোস্টেরয়েড ঔষধ সাধারণত ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, মলম, সিরাপ, ক্রিম, চোখের ড্রপ, ইনহেলার ইত্যাদি হিসেবে পাওয়া যায় যেগুলো বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা যেমন এলার্জি, ফুসকুড়ি বা অন্য চর্মরোগ, সর্দি, বাতের ব্যথা, শ্বাসকষ্ট (asthma), চোখের প্রদাহ ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়। কর্টিকোস্টেরয়েড ঔষধগুলো মূলত দেহে ২টি উপায়ে কাজ করে: 

১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অবদমিত করা

বাহ্যিক কোনো ক্ষতিকারক পদার্থ দেহের ভেতরে প্রবেশ করলে দেহের সহজাত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধের লক্ষণ হিসেবে এলার্জি, চুলকানি, ব্যথা, ফুলে যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন প্রকাশ পায়। কর্টিকোস্তেরয়েডস বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এই লক্ষণগুলো উপশম করতে সাহায্য করে। 

২. রক্তে লবণের/ আয়নের ভারসাম্য রক্ষা করা।

কর্টিকোস্টেরয়েড কিডনির উপর কাজ করে সোডিয়াম লবণের রেচন কমিয়ে দেয় এবং রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

তবে কর্টিকোস্টেরয়েডগুলো সাধারণত রক্তের লবণের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের চেয়েও এলার্জি/ প্রদাহ (inflammation)  উপশমের জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়। মূলত যেসব ক্ষেত্রে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করে না এবং প্রদাহের মাধ্যমে দেহকোষের ক্ষতি করে, সেসব ক্ষেত্রে কর্টিকোস্টেরয়েডস ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ায় কর্টিকোস্টেরয়েডস ব্যবহার করে দেহের সহজাত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত অঙ্গের ক্ষতি হ্রাস করা হয়।

কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসমূহ/ Side Effects of Corticosteroid Use

আকাঙ্ক্ষিত প্রভাবের পাশাপাশি কর্টিকোস্টেরয়েডগুলো বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যা কিছুক্ষেত্রে খুবই মারাত্মক হতে পারে। মলম বা ইনহেলার হিসেবে ব্যবহৃত কর্টিকোস্টেরয়েডগুলোর প্রভাব কেবল ব্যবহারের স্থান বা তার আশেপাশে সীমাবদ্ধ থাকলেও ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, ইঞ্জেকশন হিসেবে গৃহীত কর্টিকোস্টেরয়েড দেহের অন্যান্য অংশকেও প্রভাবিত করে। 

কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের ফলে সাধারণত যে পার্শপ্রতিক্রিয়াসমূহ দেখা যায় তা হল:

  • এটি সরাসরি কিডনির উপরে কাজ করে সোডিয়াম এর রেচন কমিয়ে দেয় এবং শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। 
  • এর ফলে চোখে গ্লুকোমা (glucoma), ছানিসহ বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করে। 
  • কর্টিকোস্টেরয়েড শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে মেদ বা চর্বিকে চেহারা এবং ধড়ে এসে জমতে প্রভাবিত হয়। ফলে  “মুন ফেস” (moon Face) অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেই সাথে এটি মাংসপেশির ক্ষয় ত্বরান্বিত করে।
  • কর্টিকোস্টেরয়েড বিভিন্ন অ্যামাইনো এসিড (amino acid) থেকে গ্লুকোজ তৈরি ত্বরান্বিত করে এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে হাইপারগ্লাইসেমিয়া (hyperglycemia), ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (insulin Resistance) ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। 
  • এক ধরনের স্টেরয়েড হওয়ায় এটি অস্টিওপোরেসিস (steoporosis)  এর মাধ্যমে হাড়ের ক্ষয় হওয়া ত্বরান্বিত করে।
  • এটি দেহের রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া (immune responses) কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এলার্জি, প্রদাহ (inflammation) ইত্যাদিকে প্রশমিত করে। এভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার ফলে দেহে সংক্রমণের ( সাধারণত candidiasis/ thrush) ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • এটি দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয় দেয়। ফলে শরীরের কোনো আঘাত বা ক্ষত নিরাময়ের ক্ষমতা হ্রাস পায়। 

এছাড়াও রক্তে পটাশিয়ামের ঘাটতি,  হাত পা ফুলে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া,  মুখে অবাঞ্ছিত লোম বৃদ্ধি পাওয়া ঘুমের সমস্যা, ডিপ্রেশন, সাইকোসিস (psychosis) সহ বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

দীর্ঘসময় কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক

কর্টিকোস্টেরয়েড সেবনের ফলে সৃষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মূলত এর ধরণ, ব্যবহারের ব্যাপ্তিকাল এবং পরিমাণের উপর নির্ভর করে।স্থানীয়ভাবে (topical) ব্যবহৃত (মলম, ইনহেলার, ড্রপ) কিংবা স্বল্প সময়ের জন্য কর্টিকোস্টেরয়েডস সেবন করলে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলো মৃদুভাবে পরিলক্ষিত হতে পারে। কিন্তু উচ্চমাত্রায় কিংবা দীর্ঘসময় কর্টিকোস্টেরয়েড সেবনের ফলে এর পার্শপ্রতিক্রিয়াগুলো গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন:

  • শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত বাচ্চাদের দীর্ঘ সময় কর্টিকোস্টেরয়েডস ব্যবহারের ফলে শারীরিক বৃদ্ধি/ উচ্চতা হ্রাস পায়।
  • দীর্ঘসময় কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের ফলে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাড়ের ক্ষয়সহ অন্যান্য ঝুঁকি বেড়ে যায়
  • দীর্ঘসময় কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহার করলে এড্রিনাল এনট্রপি (adrenal atropy) হয়, যার ফলে দেহের প্রাকৃতিক ভাবে কর্টিকোস্টেরয়েড তৈরি কমে/ বন্ধ হয়ে যায় এবং দেহ এই হরমোনের জন্য ঔষধ নির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে হঠাৎ করে ঔষধ বন্ধ করলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

দীর্ঘসময় বা উচ্চমাত্রায় কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষেত্রে কেন সতর্ক হতে হবে

কর্টিকোস্টেরয়েডের ক্ষেত্রে উপকারী প্রভাবের পাশাপাশি বেশ কিছু গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ পায়। তাই কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের শুরুতেই এর সুবিধা সাপেক্ষে ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে দেখতে হবে।

সেই সাথে দীর্ঘসময় (৩ সপ্তাহের বেশি) বা উচ্চমাত্রায় (এক সপ্তাহের জন্য প্রতিদিন ৪০ গ্রামের বেশি প্রেডনিসোলন বা সমতুল্য ঔষধ) কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের পরে হঠাৎ করেই এর ব্যবহার বন্ধ করা ঠিক নয়। কারণ দীর্ঘসময় ঔষধ ব্যবহারের ফলে দেহে প্রাকৃতিকভাবে কর্টিকোস্টেরয়েড তৈরি কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হঠাৎ করে ঔষধ নেওয়া বন্ধ করে দিলে দেহে হরমোনের ঘাটতি হয়। এতে শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় এবং দুর্বলতাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য দীর্ঘসময় বা উচ্চমাত্রায় কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের পর হঠাৎ করেই বন্ধ না করে ক্রমান্বয়ে ঔষধের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া উপশমে করণীয় 

কর্টিকোস্টেরয়েডজনিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার উপশমের জন্য যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে: 

  • ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ঔষধ সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে
  • যথাসম্ভব সর্বনিম্ন মাত্রায় এবং স্বল্প সময়ের জন্য ঔষধ ব্যবহার করতে হবে
  • একটানা নিয়মিত কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে 
  • ঔষধ পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে
  • ঔষধ সেবনের পর কোন সমস্যা চিহ্নিত হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে
  • সম্ভব হলে স্থানীয়ভাবে কার্যকরী (locally acting) ঔষধ (যেমন- মলম)  ব্যবহার করতে হবে।
  • দীর্ঘ সময় কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহার করলে অন্যান্য শারীরিক লক্ষণের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শমতো চলতে হবে
  • দীর্ঘ সময় বা উচ্চমাত্রায় ওষুধ সেবনকালে নিয়মিত রক্তচাপ এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
  • নিয়মিত হাড়ের ঘনত্ব পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং হাড়ের ক্ষয়রোধে প্রয়োজনে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট (suppliment) নিতে হবে।
  • কর্টিকোস্টেরয়েডের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি করে এমন ঔষধ  বা খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

রোগ প্রতিরোধ বা প্রতিকার করার ক্ষমতা থাকলেও সকল ঔষধেরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। হরমোনের সমতুল্য হওয়ায় কর্টিকোস্টেরয়েড শরীরের বিভিন্ন অংশকে প্রভাবিত করে এবং অধিক সংখ্যক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।  তাই কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বদাই সতর্ক হতে হবে।

আরও পড়তে পারেন

  1. Dresden D. What to know about corticosteroids. MedicalNewsToday. Mar 2020. Available from here.
  2. Ogbru O. Corticosteroids Drugs: Systemic, Oral, Injections, and Types. Medicine Net. Available from here.
  3. Prednisone and other corticosteroids. Mayo Clinic. Dec 2020. Available from here
  4. Corticosteroid. Wikipedia. Available from here
  5. How long should I be on steroid treatment for? IBD Clinic. Available from here.

আমি ফারজানা ইয়াসমিন, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। "নিজের চিন্তাধারাকে প্রকাশের জন্য লেখনী হতে পারে একটি শক্তিশালী মাধ্যম"- এই অনুভূতি থেকে লেখালেখির প্রতি আগ্রহী হই।
ফার্মাসি বা ঔষধবিদ্যা সম্পর্কে অধ্যয়নের ফলে মানবদেহের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা, রোগ-ব্যাধি, বিভিন্ন ঔষধ ও ঔষধের ব্যবহার সম্পর্কে অনেক তথ্যের সংস্পর্শে আসি এবং লেখালেখির মাধ্যমে সেগুলো সম্পর্কে নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞানকে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ছড়িয়ে দিতে অনুপ্রাণিত হই।

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.