পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) চিকিৎসায় ঔষধের যথাযথ ব্যবহার
/

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) চিকিৎসা

395 বার পড়া হয়েছে

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা পিসিওএস PCOS কি?

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PolyCystic Ovary Syndrome – PCOS) একটি জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী হরমোনজনিত ব্যাধি, যা প্রজননক্ষম ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের শরীরে পুরুষ হরমোন (অ্যান্ড্রোজেন) এর আধিক্যের কারণে হয়ে থাকে। শতকরা ৮-১০ জন নারীর মধ্যে PCOS এর সমস্যা আছে বলে ধারণা করা হয়, যা যথাযথ চিকিৎসার অভাবে আজীবন এমনকি মেনোপজ এর পরেও পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম রোগীর শরীরে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

পলি শব্দের অর্থ অনেক এবং সিস্ট বলতে বোঝায় পানিপূর্ণ থলে। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম নামটি জরায়ুতে অনেকগুলো পানিপূর্ণ (তরল-ভর্তি) থলের উপস্থিতিকে নির্দেশ করে। পিসিওএস এর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো জরায়ুতে সিস্ট এর উপস্থিতি,  তবে সকল পিসিওএস রোগীদের জরায়ুতে সিস্ট নাও থাকতে পারে। এমনও অনেক নারী রয়েছেন যাদের পিসিওএস এর সমস্যা নেই, তবে তাদের জরায়ুতে সিস্ট এর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে।

সাধারণত একজন সুস্থ নারীর শরীরে নারী হরমোন (প্রোজেস্টেরন) পুরুষ হরমোন (অ্যান্ড্রোজেন) এর তুলনায় অধিক পরিমাণে নিঃসরিত হয়, যা ডিম্বাশয় থেকে ডিমের নির্গমন কে ত্বরান্বিত করে। এই ডিম পরবর্তীতে শুক্রাণুর উপস্থিতিতে পরিণত হয় অথবা একটি সাধারণ মাসিক চক্রের মাধ্যমে শরীর থেকে নির্গত হয়ে যায়। কিন্তু নারীর শরীরে যখন অতিরিক্ত অ্যান্ড্রোজেন নিঃসৃত হয় এবং অ্যান্ড্রোজেনের প্রতি সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়, তখন ডিম্বাশয় থেকে পরিপক্ক ডিমের নির্গমন বাধাগ্রস্ত হয়। এমতাবস্থায়, অপরিপক্ক ডিম বা ডিম্বাণু গুলো ডিম্বাশয় এর আশেপাশে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি করে তাতে অবস্থান করে। ডিম্বাণুধারী এই তরল-পূর্ণ থলে (সিস্ট) গুলোকে বলা হয় ফলিকল‌স্ (সর্বোচ্চ ৮ মিলিমিটার বা ০.৩ ইঞ্চি)। ফলিকলসে ডিম্বাণু সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না, ফলে ডিম্বাণু থেকে পরিপূর্ণ ডিম্বস্ফোটন বাধাগ্রস্থ হয়, যার দরুন নিয়মিত ঋতুচক্র ও বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই দেখা যায়, PCOS আক্রান্ত মহিলাদের ডিম্বাশয়ে (ফলিকলসে্) ভালো সংখ্যায় ডিম্বাণু থাকলেও তাদের স্ফুটন পরিপূর্ণ হয় না বা ওভূ্লেশন হয় না।

অনুমান করা হয়, বিশ্বব্যাপী ১.৫৫ মিলিয়ন প্রজননক্ষম নারী পিসিওএস এ আক্রান্ত। ২০১৭ সালে, প্রজননক্ষম নারীদের পিসিওএস এর বয়স-প্রমিত ঘটনার হার ছিল প্রতি ১০০,০০০ জনসংখ্যার ৮২.৪৪ জন, যা ২০০৭ সালের তুলনায় ১.৪৫ শতাংশ বেশি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন ও বিপাকীয় ব্যাধি হিসেবে স্বীকৃত কারণ এটি ডিম্বাশয় কে প্রভাবিত করে এবং ৪০ শতাংশ পিসিওএস এ আক্রান্ত নারী ইনসুলিন প্রতিরোধ জনিত সমস্যায়ও ভুগে থাকেন যা পরবর্তীতে টাইপ টু ডায়াবেটিস বিকাশের সম্ভাবনাকেও বৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশে PCOS এর প্রকোপ সংক্রান্ত তথ্য খুবই কম। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে ২২ শতাংশ প্রজননক্ষম নারী পিসিওএস এর সমস্যায় ভুগছেন। ১৬,৭০০ জন বন্ধা নারীর উপর করা এক গবেষণায় ৩১.৭ শতাংশ নারীর দেহে পিসিওএসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এই উচ্চ প্রসার, নারীর জীবনমান হ্রাস করে ডিজেবিলিটি-এডজাস্টেড লাইফ ইয়ার্স এর বৃদ্ধি কে নির্দেশ করে।

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা PCOS এর লক্ষণ কি

সাধারণত নারী দেহে নিম্নোক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্যের যেকোনো দুটি পরিলক্ষিত হলে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম হয়েছে বলে ধারণা করা হয়:

  • অনিয়মিত ঋতুচক্র অথবা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া (ডিম্বস্ফোটনের অভাবে)
  • উচ্চ মাত্রার অ্যান্ড্রোজেন এবং এর প্রভাবে মুখে ও শরীরে অবাঞ্ছিত লোম (হিরসুটিজম), ব্রণ ও চুল   পড়ে যাওয়ার সমস্যা
  • ডিম্বাশয়ে ২০ বা ততোধিক ফলিকলের উপস্থিতি (ওভারিয়ান সিস্ট)।

PCOS এর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। গবেষণায় দেখা গেছে, জিনগত, পরিবেশগত, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, স্থুলতা, মানসিক চাপ- এমন আরও বিভিন্ন কারণে পিসিওএস হতে পারে। তাই গবেষকগণ এটিকে একটি মাল্টি ফ্যাক্টরিয়াল (বহুমুখী) ও হেটেরোজেনাস (ভিন্নধর্মী) ডিজিজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা PCOS এর চিকিৎসা ও সমাধানের উপায়

দুর্ভাগ্যবশত, পিসিওএস এর কোন স্থায়ী সমাধান নেই। এবং যেহেতু একাধিক কারণে পিসিওএস হয়ে থাকে তাই এর কোন একক চিকিৎসাও এখনো উদ্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে, এই রোগের চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্যই হল রোগঘটিত লক্ষণ গুলোর প্রতিকার এবং সুদূরপ্রসারী জটিলতা সমূহ প্রতিহত করা। এই রোগের লক্ষণ গুলো প্রশমিত করতে এবং জীবন মান উন্নতিকরণে প্রথম ও অন্যতম প্রধান পন্থাই হল নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন।

নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন

PCOS কে বলা হয় ‘ডিজিজ অব লাইফস্টাইল – LIFESTYLE DISEASES‘। অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন, স্থূলতা ইত্যাদি যেমন এই রোগের জন্য ট্রিগার হিসেবে কাজ করে, তেমনি স্বাস্থ্যসম্মত জীবন ব্যবস্থাপনা, ওজন নিয়ন্ত্রণ এই রোগঘটিত লক্ষণ গুলোর প্রতিকারে সহায়তা করে এবং দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা গুলো প্রতিরোধেও অনন্য ভূমিকা পালন করে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপনের প্রধান শর্তগুলো হল সঠিক খাদ্যাভ্যাস বাছাই করা, কায়িক পরিশ্রম বা শারীরিক কসরতের মাধ্যমে শরীরকে সচল রাখা, পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা, অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস যেমন ধূমপান, পানীয় পান ইত্যাদি বর্জন করা এবং মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা।

ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা

ঔষধের মাধ্যমে PCOS এর চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, রোগের তীব্রতা, রোগীর শারীরিক সক্ষমতা ও গর্ভধারণের ইচ্ছের উপর। মার্কিন খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন (U.S Food and Drug administration) পিসিওএসের চিকিৎসায় কিছু ঔষধকে অনুমোদন দিয়েছে যাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি গর্ভাবস্থায় নিষিদ্ধ। এই রোগের চিকিৎসায় লক্ষণ ভিত্তিক এবং রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী ঔষধ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিভিন্ন কারণে এই রোগের সূত্রপাত হতে পারে যা ভিন্ন ভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র।

PCOS ঘটিত লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধের তালিকা

ঔষধের জেনেরিক নামপরিচিতিনির্দেশনাসাধারণ মাত্রাপরিচিতি মূলক নাম (ব্র্যান্ড নেইম)
মেটফর্মিন (Metformin)ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি কারী এজেন্টঅবাঞ্ছিত লোমের সমস্যা বা হিরসুটিজম

বন্ধ্যাত্ব

ইনসুলিন রেজিস্টেন্স

অনিয়মিত ঋতুচক্র
৫০০ মিলিগ্রাম
৮৫০ মিলিগ্রাম
১০০০ মিলিগ্রাম

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবনযোগ্য
কমেট (Comet)
বিগমেট (Bigmet)
ডাওমিন (Daomin)
ফরমেট (Formet)
এক্সফরমিন ইআর (Exformin ER)
বেনফরমিন (Benformin)
ইথিনাইল এস্ট্রাডায়ল+ ড্রোসপিরেনোন (Ethinyl Estradiol+Drospirenon)জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (কম্বিনেশন), যেসব রোগী গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন না হিরসুটিজম
অনিয়মিত ঋতুচক্র
০.০২ মিলিগ্রাম+ ৩ মিলিগ্রাম

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবনযোগ্য
এলিসা (Elisa)
নোভেলন লাইট (Novelon Lite)
রোজেন গোল্ড (Rosen Gold)
মেড্রোঅক্সিপ্রোজেস্টেরণ অ্য‌াসিটেট (Medroxyprogesteron acetate)জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (প্রোজেস্টিন-ওনলি), যেসব রোগী গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন না হিরসুটিজম
অনিয়মিত ঋতুচক্র
৫ মিলিগ্রাম
১০ মিলিগ্রাম

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে
মেড্রোক্সি (Medroxy)
মেড্রোজেস্ট (Medrogest)
পারলুটেক্স (Perlutex)
প্রোভেণর (Provenor)
ক্লোমিফেন (Clomiphene)ডিম্বস্ফোটন উদ্দিপক এজেন্ট (ওভুলেশান-ইন্ডাকশন এজেন্ট), যেসব রোগী গর্ভধারণের চেষ্টা করছেনবন্ধ্যাত্ব৫০ মিলিগ্রাম
১০০ মিলিগ্রাম

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবনযোগ্য
ফারটিল (Fertil)
ওভুলেট (Ovulet)
ফারমিড (Fermid)
ওভুক্লোন (Ovuclon)
রিওমেন (Reomen)
স্পাইরোনোল্যাকটোন (Spironolactone)অ্য‌ান্টি-অ্য‌ান্ড্রোজেনিক
অ্য‌ান্টি-মিনারেলোকর্টিকয়েড
হিরসুটিজম
অনিয়মিত ঋতুচক্র
২৫ মিলিগ্রাম
৫০ মিলিগ্রাম
১০০ মিলিগ্রাম

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবনযোগ্য
স্পাইরোকার্ড (Spirocard)
ইনোস্পিরন (Inospiron)
ভেরোস্পিরন (Verospiron)
স্পাইরেটিক (Spiretic)
এফ্লোরনিথীন (Eflornithin)অবাঞ্ছিত লোম দমনকারিহিরসুটিজম১৩.৯% ক্রিম
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবনযোগ্য
ইলোরিম (Elorim)
ভেনিফ্লো (Vaniflo)
ঔনিকা (Wonica)
PCOS ঘটিত লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধের তালিকা (বাংলাদেশি ব্রান্ড) (ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ব্যবহার করা যাবে না)

গর্ভধারণের জন্য চেষ্টা করছেন না এমন নারীদের জন্য আরোও বিভিন্ন জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি যেমন- ইথিনাইল এস্ট্রাডায়ল+লেভোনরজেস্ট্রেল কম্বিনেশন পিল (মায়াপিল, ফেমিপিল), নর‌এথিস্টেরণ (নরমেন্স, ইথিনর, ফেমিনর), ড্রোসপিরেণন ৪ মিলিগ্রাম (ড্রোসলিন, ড্রোসপি) ইত্যাদি প্রথম সারির চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

গবেষণায় দেখা গেছে, পিসিওএস এ আক্রান্ত অধিকাংশ নারীর শরীর ইনসুলিনের প্রতি অসারতা প্রদর্শন করে, যা পরবর্তীতে হাইপারইন্সুলিনেমিয়া (শরীরে ইনসুলিনের অধিক মাত্রা) ও হাইপার‌অ্য‌ান্ড্রোজেনেমিয়া (অ্য‌ান্ড্রোজেনের আধিক্য) ঘটায় এবং ফলস্বরূপ পিসিওএস এর সূত্রপাত ঘটে।

তাই বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে ইন্সু্লিন-সংবেদনশীল এজেন্ট যেমন মেটফর্মিন (Metformin), রসিগ্লিটাজোন (Rosiglitazone), পায়োগ্লিটাজোন (Pioglitazone) ইত্যাদি অ্য‌ান্টি-ডায়াবেটিক ঔষধ নির্দেশিত হয়, কারণ তাদের ইন্সুলিন রেজিস্টেন্স, অনিয়মিত ঋতুচক্র, অ্য‌ানোভুলেশন, অবাঞ্ছিত লোম এবং স্থূলতার উপর ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এ জাতীয় ঔষধের মধ্যে মেটফর্মিনের কার্যকারিতা সমর্থনকারী তথ্য সবচেয়ে বেশি।

আমি জান্নাতুল ফেরদৌস, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে স্নাতকোত্তর কোর্সে অধ্যয়নরত আছি। ফার্মেসি বিভাগে অধ্যয়নের সুবাদে ঔষধ সম্পর্কে অর্জিত সামান্য জ্ঞান আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঔষধের সঠিক ব্যবহার কতটা প্রয়োজনীয় এবং এর অনিরাপদ ও অনিয়ন্ত্রিত সেবন কিভাবে দিন দিন আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে। তাই, জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষালব্ধ এই স্বল্প জ্ঞানকে আমি আমার লেখার মাধ্যমে সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। এবং প্রত্যাশা করি ভবিষ্যতে গবেষণামূলক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে আমি ঔষধ স্বাস্ত্র্যকে আরো সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হব।

2 Comments

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.