পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) চিকিৎসায় ঔষধের যথাযথ ব্যবহার
/

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) চিকিৎসা

357 বার পড়া হয়েছে

মেটফরমিন (Metformin)

মেটফরমিন হচ্ছে একটি বাইগুয়ানাইড শ্রেণীর মুখে সেবনকৃত ডায়াবেটিস বিরোধী ঔষধ যা সাধারনত টাইপ টু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়। এটি বাজারে সাধারণত কমেট (Comet), বিগমেট (Bigmet), ডাওমিন (Daomin), এক্সফর্মিন ইআর (Exformin ER), ফরমেট (Formet) ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়।

মেটফরমিন কোথায় ব্যবহৃত হয়

  • পিসিওএসের চিকিৎসায় মেটফর্মিন শরীরে ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং স্থূলতা সহ পিসিওএস ঘটিত অন্যান্য লক্ষণ যেমন অনিয়মিত মাসিক, অবাঞ্ছিত লোম (হিরসুটিজম) ও ব্রণের সমস্যা প্রশমিত করতে সাহায্য করে।
  • এটি পরবর্তীতে ডায়াবেটিস মেলাইটাস হবার ঝুঁকি কমায় এবং ডিম্বস্ফোটনকেও উদ্দীপিত করে।
  • যেসব রোগী ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে মেটফর্মিন ডিম্বাশয়ের হাইপারস্টিমুলেশন সিনড্রোম (ডিম্বাশয়ের অত্যধিক কার্যকারিতা) হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

মেটফরমিন কিভাবে কাজ করে

মেটফরমিন যকৃতের গ্লুকোজের উৎপাদন কমায়, অন্ত্রের গ্লুকোজ শোষণ কমায় এবং পেরিফেরাল গ্লুকোজ গ্রহণ ও ব্যবহারকে বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে, রক্তে সঞ্চালিত ইনসুলিনের মাত্রা কমায়, যার ফলস্বরূপ স্বাভাবিক অবস্থায় ও খাবারের পরে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হ্রাস পায়। 

মেটফরমিন রক্তে অধিক মাত্রায় সঞ্চালিত অ্য‌ান্ড্রোজেনের পরিমাণ হ্রাস করে যার ফলে হাইপার‌অ্য‌ান্ড্রোজেনিক লক্ষণসমূহ যেমন-অনিয়মিত মাসিক, অবাঞ্ছিত লোম ও ব্রণের সমস্যা প্রশমিত হয়।

মাত্রা ও সেবনবিধি

মেটফরমিন ৫০০, ৮৫০ এবং ১০০০ মিলিগ্রাম এর ট্যাবলেট আকারে বাজারজাত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পিসিওএস এর চিকিৎসায় মেটফর্মিন এর মাত্রার সরাসরি কোন প্রভাব নেই, তবে সহনশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে সর্বনিম্ন মাত্রায় ঔষধ সেবন নিরাপদ। পিসিওএস এর চিকিৎসায়:

মেটফরমিন এর প্রাথমিক সেবনমাত্রা – ডাক্তারের পরামর্শে

  • প্রথম সপ্তাহে মেটফর্মিন ৫০০ মিলিগ্রাম দৈনিক একবার সকালে খাবারের সাথে।
  • দ্বিতীয় সপ্তাহে ৫০০ মিলিগ্রাম দৈনিক দুইবার খাবারের সাথে।

এভাবে ওষুধের মাত্রা সপ্তাহে ৫০০ মিলিগ্রাম করে বাড়িয়ে, রোগীর প্রয়োজনীয়তা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে বিভক্ত (২-৩ বারে) মাত্রায় দৈনিক ১.৫-১.৭ গ্রাম পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে। বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণে বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। ঔষধের প্রতি সহনশীল না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক সেবনমাত্রা বজায় রাখতে হবে।

যে ক্ষেত্রে মেটফরমিন ব্যবহার করা যাবে না

  • ওষুধের সক্রিয় উপাদান অথবা অন্য যেকোন উপাদানের প্রতি অতি সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রে।
  • যেকোনো ধরনের বিপাকীয় এসিডোসিস যেমন ল্যাকটিক অ্যাসিডোসিস (শরীরে ল্যাকটেটের মাত্রা বৃদ্ধি), ডায়াবেটিক কিটোঅ্য‌াসিডোসিস (রক্তে কিটোনবডির পরিমাণ বৃদ্ধি) ইত্যাদির ক্ষেত্রে।
  • কিডনির মারাত্মক বিপর্যয় (জিএফআর <৩০ মিলি/মিনিট)।
  • তীব্র অথবা দীর্ঘমেয়াদি রোগ যা টিস্যুর অক্সিজেনের পরিমাণ কমাতে পারে যেমন-হৃৎপিণ্ড অথবা শ্বাসনালীর অকার্যকারিতা, যকৃতের অকার্যকারিতা, মদ জাতীয় পানীয়র প্রতি অতি আসক্তি, সাম্প্রতিক মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (হৃদপিন্ডের আন্তঃকোষের ক্ষয়)।

মেটফরমিন এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

  • পরিপাকতন্ত্র সংক্রান্ত সমস্যা

সাধারণত মেটফর্মিন গ্রহণে পরিপাকতন্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা যেমন-বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা এবং ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি হতে পারে। চিকিৎসার শুরুর দিকে এই সমস্ত উপসর্গ প্রায়শই ঘটে থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাধান‌ও হয়ে যায়। এইসব বিরূপ প্রতিক্রিয়া সমূহ প্রতিরোধ করতে ওষুধটির মাত্রা বৃদ্ধি ধীর গতিতে করতে হবে। মাত্রার ধীর গতিতে বৃদ্ধি পরিপাকতন্ত্র সংক্রান্ত সহনশীলতার সক্ষমতাকে উন্নত করবে।

  • পরিপাক এবং পুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা

মেটফর্মিন গ্রহণে খুবই বিরল একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হল ল্যাকটিক অ্য‌াসিডোসিস, যা মারণঘাতী হতে পারে তাই সতর্কতা অবলম্বন বাঞ্ছনীয়। দীর্ঘদিন মেটফর্মিন গ্রহণে ভিটামিন বি১২ এর শোষণ হ্রাসের সাথে রক্তে ভিটামিন বি১২ এর পরিমাণ কমতে পারে। রোগীর মেগালোব্লাস্টিক এনিমিয়া (রক্তকণিকার আকার বৃদ্ধি জনিত রক্তস্বল্পতা) উপস্থিত থাকলে সে ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা নির্দেশিত হবে।

  • স্নায়ুতন্ত্র সংক্রান্ত সমস্যা

খাবারের স্বাদ গ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

মেটফরমিন এর সাথে অন্যান্য ঔষধের রিএকশন

  • অ্যালকোহল ল্যাকটেট মেটাবলিজম এর উপর মেটফর্মিনের প্রভাব কে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
  • কার্বনিক অ্য‌ানহাইড্রাস (টপিরাম্যাট, জোনিস্যামাইড) এর সাথে একত্রে ব্যবহারে ল্যাকটিক এসিডোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
  • কিছু ঔষধ (রেনোলাজিন, সিমেটিডিন, ডলুটেগ্রাভির) মেটফর্মিনের শরীর থেকে বের হ‌য়ে যাওয়ার পরিমাণকে হ্রাস করে, তাই এদের একত্রে ব্যবহারে শরীরে মেটফর্মিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে।

মেটফরমিন গ্রহণ বা নির্দেশনায় সতর্কতা

  1. মেটফর্মিন কিডনির মাধ্যমে দেহ থেকে ধীরে ধীরে বের হয়। শরীরে মেটফর্মিন জমা হওয়া ও ল্যাকটিক অ্যাসিডোসিস হওয়ার সম্ভাবনা কিডনির অক্ষমতার উপর নির্ভর করে‌। তাই কিডনির কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে মেটফরমিনের মাত্রা সমন্বয় করা উচিত এবং কিডনির কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত।
  2. মেটফরমিনের মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে নিঃসৃত হয়। তাই মেটফরমিন দিয়ে চিকিৎসা চলাকালে স্তন্যদান নির্দেশিত নয়।

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা PCOS ও বন্ধ্যাত্ব

অনেকেই মনে করেন PCOS আক্রান্ত রোগীদের পক্ষে গর্ভধারণ সম্ভব নয়। যা একেবারেই ভুল ধারণা। পিসিওএসে আক্রান্ত অনেক নারীই স্বাভাবিকভাবেই গর্ভধারণ করে থাকেন। এটা সত্যি যে, যেহেতু এই ধরনের রোগীদের ডিম্বস্ফোটন অস্বাভাবিক ও অনিয়মিত হয়, তাই অনেকের ক্ষেত্রেই গর্ভধারণের সমস্যা হয়। তবে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ওজন‌ হৃাস ও সঠিক চিকিৎসায় শতকরা ৮০ জন নারীই সফলভাবে গর্ভধারণে সক্ষম হন।

PCOS আক্রান্ত নারীদের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, বন্ধ্যাত্বের সময় ও অন্যান্য কারণের উপর। সাধারণত বন্ধ্যাত্বের প্রথম চিকিৎসা হলো ওভুলেশন ইন্ডাকশন অর্থাৎ ডিম্বস্ফোটনকে উদ্দীপিত করে এমন ঔষধ গ্রহণ করা। শুধুমাত্র ক্লোমিফেন অথবা মেটফরমিন এবং ক্লোমিফেন এর সমন্বয়ে তৈরি ঔষধ ডিম্বস্ফোটনের জন্য প্রথম সারির ঔষধ নির্ভর চিকিৎসা হিসেবে বিবেচিত হয়।

বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় লেট্রোজোল (ফিজোল, লেট্রোজেন, লেক্সেল, ওভাজোল, জোলেটা), রসিগ্লিটাজোন+মেটফর্মিন (ওরামেট প্লাস), পায়োগ্লিটাজোন (অ্য‌াকটোজ, গ্লিটাজোন, পিজিটি, পায়োলিট, পিজ্জি, লিট) ইত্যাদি ঔষধ ও ব্যবহৃত হয়।

আমি জান্নাতুল ফেরদৌস, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে স্নাতকোত্তর কোর্সে অধ্যয়নরত আছি। ফার্মেসি বিভাগে অধ্যয়নের সুবাদে ঔষধ সম্পর্কে অর্জিত সামান্য জ্ঞান আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঔষধের সঠিক ব্যবহার কতটা প্রয়োজনীয় এবং এর অনিরাপদ ও অনিয়ন্ত্রিত সেবন কিভাবে দিন দিন আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে। তাই, জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষালব্ধ এই স্বল্প জ্ঞানকে আমি আমার লেখার মাধ্যমে সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। এবং প্রত্যাশা করি ভবিষ্যতে গবেষণামূলক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে আমি ঔষধ স্বাস্ত্র্যকে আরো সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হব।

2 Comments

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.