ডায়াবেটিস/ Diabetes বলতে সাধারণত রক্তে অধিক মাত্রার গ্লুকোজের উপস্থিতি বোঝায়। এটি একটি হরমোন সংশ্লিষ্ট রোগ, যেক্ষেত্রে আমাদের দেহে পরিমান মতো ইনসুলিন তৈরি না হলে বা ঠিকমতো কাজ না করলে, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থেকে বেড়ে যায়।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসেব মতে, বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৪৬৩ মিলিয়ন, অর্থাৎ প্রতি ১১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ডায়াবেটিস রোগীর দিক থেকে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে অবস্থান করছে।
এই ওয়েবসাইটে আরো পড়ুন –
- ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় পেশেন্ট এজুকেশন
- ডায়াবেটিসে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করা কেন জরুরি!
- ডায়াবেটিস কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন?
- অ্যান্টি-ডায়াবেটিক ওষুধ — মেটফরমিন
- বাংলাদেশে টাইপ- ২ ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় পেশেন্ট কমপ্লায়েন্সের গুরুত্ব
সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার কারণে প্রতিবছর অসংখ্য লোক মারা যাচ্ছে। বর্তমানে চলমান মহামারী কোভিড-১৯ সংক্রমণ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রাণঘাতী। যথাযথ স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান এ রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে।
ডায়াবেটিস কিভাবে হয়?
আমাদের গ্রহণ করা খাবার পরিপাক হয়ে যে চিনি বা গ্লুকোজ তৈরি হয় তা শরীরের বিভিন্ন কোষে পৌঁছাতে সাহায্য করে একধরণের হরমোন, যার নাম ইনসুলিন/ Insulin। ইনসুলিন রক্ত থেকে গ্লুকোজ/ Glucose কে বিভিন্ন কোষে নিয়ে যায়। কোষের ভিতর গ্লুকোজ তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয় অথবা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত হয়। যখন অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন উৎপাদন হতে পারেনা অথবা শরীর ইনসুলিন কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনা তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এ অবস্থাকে বলা হয় ডায়াবেটিস। অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে সেটাকে বলা হয় টাইপ-১ ডায়াবেটিস/ Type 1 Diabetes। আর যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদিত না হলে অথবা কাজ না করলে সেটাকে বলা হয় টাইপ-২ ডায়াবেটিস/ Type 2 Diabetes.
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস হলে সেটার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা অথবা সামলাতে না পারার কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে সে অবস্থাকে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস বলা হয়। সাধারণত খাবার গ্রহণের দুই ঘন্টা পরবর্তী পরীক্ষার ক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ১৪০ মি.গ্রা/ডেসি.লি এর কম হলে একে স্বাভাবিক ধরা হয়। ১৪০ মি.গ্রা/ডেসি.লি থেকে ১৯৯ মি.গ্রা/ডেসি.লি (৭.৮ মি.মোল/লি থেকে ১১ মি.মোল/লি) গ্লুকোজ মাত্রা কে ডায়াবেটিসের পূর্ববর্তী অবস্থা এবং ২০০ মি.গ্রা/ডেসি.লি (১১.১ মি.মোল/লি) এর উপরে রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা পাওয়া গেলে এ অবস্থাকে ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডায়াবেটিস হয়ে গেলেও এক্ষেত্রে গ্লুকোজের মাত্রা থাকা উচিত ৭০মি.লি/ডেসি.লি থেকে ১৪০ মি.গ্রা/ডেসি.লি (৩.৯ থেকে ৭.৮ মি.মোল/লি) এর মধ্যে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা থাকে ১৪০ মি.গ্রা/ডেসি.লি (৭.৮ মি.মোল/লি) বা তার বেশি এবং গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিনের মাত্রা থাকে > ৭%।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণ
বিভিন্ন কারণে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় পৌঁছাতে পারে। অনেক সময় তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশিত না হওয়ায় এবং ব্লাড গ্লুকোজ চেক না করার কারণে মানুষ জানতেই পারেনা যে ডায়াবেটিস হয়েছে।
যেসব ফ্যাক্টরসমূহ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ঘটাতে পারে তা নিম্নরূপ :-
- নিয়মিত রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা পরীক্ষা না করা,
- ডায়াবেটিস খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ না করা,
- অপর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়াম,
- ডায়াবেটিস এর সঠিক ঔষধ অথবা সঠিক ডোজ না নেয়া,
- অন্য কোনো রোগ অথবা ঔষধের ব্যবহার, যা ডায়াবেটিস চিকিৎসায় বিঘ্ন ঘটায়,
- পর্যাপ্ত ইনসুলিন গ্রহণ না করা,
- যথাযথভাবে ইনসুলিন ইনজেকশন দিতে না পারা অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ ইনসুলিন ব্যবহার করা,
- স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করা,
- মানসিক অবসাদ অথবা বিষন্নতায় থাকা।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের লক্ষণসমূহ
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া,
- ঘন ঘন তৃষ্ণার্ত হওয়া,
- ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া,
- ক্ষত বা ঘা না শুকানো,
- অতিরিক্ত ক্লান্তি,
- ঝাপসা দৃষ্টি,
- নিঃশ্বাসে অ্যাসিটোনের গন্ধ,
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা
স্বল্পমেয়াদী জটিলতা
- ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস- চর্বি ভেঙে রক্তে কিটোন তৈরি হয়ে রক্তের অম্লত্ব অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া এবং বাইকার্বনেট কমে যাওয়া।
- হাইপারগ্লাইসিমিয়া- রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে যাওয়া (> ৫৫ মিলিমোল/লি.)
দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা
- ম্যাক্রোভাসকুলার
- হার্ট অ্যাটাক
- স্ট্রোক
- পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ
- মাইক্রোভাসকুলার
- কিডনি সমস্যা (nephropathy)
- চক্ষু সমস্যা (retinopathy)
- স্নায়ু সমস্যা (neuropathy)
চিকিৎসা এবং করণীয়
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা থেকে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা না নিলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। যেমন: ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস। এটি একটি জরুরি অবস্থা এবং এ ধরনের রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। দেহে প্রচণ্ড পানিশূন্যতা দেখা দেয়ার কারণে এ ধরণের রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে, এক্ষেত্রে রোগীকে শিরার মাধ্যমে দ্রুত স্যালাইন প্রদান এর ব্যবস্থা করা উচিত।
- টাইপ-১ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয়।
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন এবং ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
- প্রায় ৮০% টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগী মাত্রাধিক ওজনের হয়ে থাকে এবং ফলস্বরূপ ইনসুলিনের প্রতি অসংবেদনশীল (resistant) হয়ে থাকে।
- ৭৫% টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়না, সাথে প্রয়োজনীয় ঔষধ গ্রহণের দরকার হয়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যবহৃত ঔষধসমূহকে ছয়টা শ্রেণী তে বিভক্ত করা যায়:-
১. বিগুয়ানাইড (Biguanide)
- মেটফরমিন (Metformin)
উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড নাম: কোমেট (comet), গ্লুনর (glunor) etc.
২. সালফোনিলইউরিয়া (sulphonylureas)
- গ্লিবেনক্ল্যামাইড (glibenclamide),
- গ্লিক্ল্যাজাইড (gliclazide),
- গ্লিমেপিরাইড (glimepiride),
- গ্লিপিজাইড (glipizide),
- টলবিউটামাইড (tolbutamide)।
উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড নাম: ডাইবেনল (dibenol), ডাইঅ্যাকটিন (diactin), গ্লুমিন প্লাস (glumin plus) etc.
৩. মেগ্লিটিনাইড (Meglitinide)
- রেপাগ্লিনাইড (Repaglinide)
উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড নাম: গ্লিমেট (glimet), প্রেমিল (premil) etc.
৪. থিয়াজোলিডিনডাইওন (Thiazolidinedione)
- পাইওগ্লিটাজোন (pioglitazone),
- গ্লিটাজোন (glitazone)
- রসিগ্লিটাজোন (rosiglitazone)
উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড নাম: অ্যাডপাস (adpas), রোমেরল (romerol) etc.
৫. আলফা গ্লুকোসাইডেজ ইনহিবিটর (Alpha glucosidase inhibitor)
- অ্যাকার্বোজ (acarbose)
উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড নাম: অ্যাকারিল (acaril), গ্লুকো- এ (gluco-A) etc.
৬. ডাইপেপটাইডিল পেপটাইডেজ-৪ ইনহিবিটর (Dipeptidyl peptidase-4 inhibitor)
- স্যাক্সাগ্লিপ্টিন (saxagliptin),
- সিটাগ্লিপ্টিন (sitagliptin),
- ভিলডাগ্লিপ্টিন (vildagliptin)
উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড নাম: গ্লাইজা (glyza), গ্লিপিটা (glipita), গ্লুভান (gluvan) etc.
ডায়াবেটিস একটি পরিচিত সমস্যা। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ডায়াবেটিস হওয়াটা এখন যেনো একটি অনিবার্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে এটি আগের মতো ভয়ংকর কোনো বিষয় নয়। যেসব রোগী ইনসুলিনের উপর নির্ভরশীল তারা কোনো অবস্থাতেই ইনসুলিন বন্ধ করা উচিত নয়। ডায়াবেটিসের যেসব রিস্ক ফ্যাক্টর আছে, যেমন: শারীরিক পরিশ্রম না করা, চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত ওজন, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এসব বিষয় পরিহার করা উচিত। সর্বোপরি, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং সঠিক জীবনধারা বজায় রেখে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
রেফারেন্স
- IDF news [Internet]. Idf.org. 2019 [cited 5 March 2022].
- Diabetes and Endocrine Function [Internet]. Endocrine.org. 2022 [cited 5 March 2022].
- Prediabetes – Diagnosis and treatment – Mayo Clinic [Internet]. Mayoclinic.org. 2022 [cited 5 March 2022].
- Peterson T. What is Uncontrolled Diabetes? | HealthyPlace [Internet]. Healthyplace.com. 2022 [cited 5 March 2022].
- Moses R. G. Combination therapy for patients with Type 2 diabetes: repaglinide in combination with metformin. Expert Rev Endocrinol Metab. 2010; 5(3): 331–342.