শুরুতেই আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া কিছু রূপক কিন্তু বাস্তবধর্মী ঘটনার সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
০১. জনাব রাকিব একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কিছুদিন বেশ কিছুদিন ধরে তার পায়ে পুঁজযুক্ত ফোঁড়ার সমস্যা হওয়ায় তাকে চিকিৎসক দিনে ৪ বার ১ টি করে ফ্লুক্লক্সাসিলিন ২৫০ মিলিগ্রাম ঔষধ প্রেসক্রাইব করেন। কিন্তু তিনি অফিসের কাজের চাপে প্রায়ই দুপুরের ঔষধ খেতে ভুলে যান।
০২. মিসেস ফাতিমা ৩৫ বছর বয়স্ক এক গ্রাম্য অস্বচ্ছল নারী। তিনি বেশ কয়েকদিন যাবৎ জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত। তিনি নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার তাকে এজিথ্রোমাইসিন ৫০০ মিলিগ্রাম ৫ দিন (২ বার) করে খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু দুদিন খাওয়ার পর তার জ্বর ভালো হয়ে গেলে তিনি সেটি ইচ্ছে করেই বন্ধ করে দেন, কারণ ঔষধটি বেশ দামী ছিলো।
০৩. ৪৭ বছর বয়সী জনাব আব্দুর রহিম বেশ কয়েকবছর যাবৎ অ্যাজমাতে ভুগছেন। সম্প্রতি তার উচ্চরক্তচাপ ধরা পড়ে। তাঁকে তার চিকিৎসক বিসপ্রোলোল ৫ মিলিগ্রাম করে খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু বিসপ্রোলোলের বদলে এক রাতে তার বাসায় আগে থেকে থাকা উচ্চরক্তচাপের ঔষধ প্রোপানোলোল খেলে হঠাৎ করেই তাঁর অ্যাজমার সমস্যা বেড়ে যায়।
০৪. ইলিয়াস চৌধুরীর সাম্প্রতিক টাইপ-২ ডায়াবেটিস ধরা পড়লে চিকিৎসক ইনসুলিন নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ফার্মেসী থেকে ইনসুলিন কিনে নিয়ে তিনি রেফ্রিজারেটরে না রেখে সাধারণ অন্যান্য ঔষধের সাথে তিনি সেটি ড্রয়ারে রেখে দেন।
০৫. জুনায়েদ ১৪ বছর বয়েসী এক কিশোর। সম্প্রতি তার গ্যাস্ট্রাইটিসের সমস্যা হলে চিকিৎসক তাকে ইসোমিপ্রাজল ক্যাপসুল খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু একই সাথে তার বমির সমস্যা থাকায় সে ঠিকঠাকভাবে ক্যাপসুল খেতে পারে না।
উপরের উদাহরণগুলোর প্রতিটিরই একটি সাধারণ ফলাফল দেখা যায়, সেটি হলো ঔষধের কার্যকারিতা কমে আসা কিংবা রোগের পর্যাপ্ত প্রতিকার না পাওয়া অথবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়া। ভোক্তাপর্যায়ের এই সমস্যাগুলো নিরসনেই “পেশেন্ট কমপ্লায়েন্স – patient compliance” ধারণাটির উৎপত্তি। পেশেন্ট কমপ্লায়েন্স বলতে বোঝায় রোগী ঠিক কতটুকু পরিমান ডাক্তার কিংবা ফার্মাসিস্টের তার প্রেসক্রিপশন ও অন্যান্য উপদেশ মেনে চলছে। উপদেশ মেনে চলার মধ্যে সঠিক সময়ে সঠিক ঔষধ, সঠিক নিয়মে, সঠিক ডোজে, সঠিক ডোজেস ফর্মে, সঠিকভাবে খাবারের সাথে গ্রহণ করছে কিনা; এই বিষয়গুলো বলে বিবেচনা করা হয়। ৮০-৯০% কমপ্লায়েন্স হলে ধারণা করা হয় যে, ঔষধটি সঠিকভাবে নিয়ম মেনে গ্রহণ করা হয়েছে। বিপরীতার্থে, রোগী ঠিকঠাকভাবে নিয়ম না মেনে ঔষধ গ্রহণ করলে সে ঘটনাকে নন-কমপ্লায়েন্স – non-compliance বলে অ্যাখা দেওয়া হয়।
নন-কমপ্লায়েন্স ঘটার কারণসমূহ
সাধারণত নন-কমপ্লায়েন্স ঘটার পেছনে তিনটি স্টেকহোল্ডার কাজ করে।
০১. চিকিৎসক ০২. রোগী ০৩. ফার্মাসিস্ট (রোগী যেখান থেকে ঔষধ ক্রয় করছে)
০১. চিকিৎসক: একজন চিকিৎসক কর্তৃক non-compliance ঘটে যখন-
- সঠিকভাবে রোগের ডায়াগনোসিস করতে ব্যর্থ হয়।
- যখন ঔষধের ডোজ ও গ্রহণ নির্দেশনা সঠিকভাবে স্পষ্ট আকারে লিখিত না থাকে।
- যখন প্রেসক্রিপশন এর লেখা খুব অস্পষ্ট থাকে।
- কোন ঔষধ কোন রোগের জন্য খেতে হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত ধারণা না দিলে।
- যখন রোগীর সম্পূর্ণ মেডিকেল হিস্ট্রি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না।
- যখন চিকিৎসক একজন রোগীর জন্য খুব অল্প পরিমাণ সময় বরাদ্দ রাখেন ইত্যাদি।
০২. রোগী: একজন রোগীর যে আচরণগুলো নন-কমপ্লায়েন্স ঘটায় সেগুলো-
- যখন রোগীর ঔষধ এবং অসুখ সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্ঞান থাকে না।
- যখন রোগী ইচ্ছাকৃতভাবেই তার ওষুধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
- যখন রোগী সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে ঔষধ গ্রহণ করে না।
- যখন ঔষধের দাম খুব বেশি থাকে।
- একাধিক রোগে আক্রান্ত রোগীকে যখন অনেকগুলো ঔষধ একসাথে গ্রহণ করতে হয়।
০৩. ফার্মাসিস্ট বা ডিসপেন্সার: ফার্মাসিস্টের যেসকল ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলে নন-কমপ্লায়েন্স হয়-
- যখন প্রেসক্রিপশন ভুল ভাবে পড়া হয় তখন ভুল ঔষধ রোগীকে দিয়ে দিলে।
- মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরবরাহ করলে।
- সঠিকভাবে তার ঔষধ গুলো কিভাবে গ্রহণ করতে হবে তার সম্পর্কে ব্রিফিং না দিলে।
- অক্ষরজ্ঞানহীন রোগীকে তার ঔষধ সমুহ কিভাবে গ্রহণ করতে হবে তা প্রতীক বা চিহ্নের মাধ্যমে চিহ্নিত করে না দিলে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নন-কমপ্লায়েন্স ও এটি নিরসনে করণীয়
অন্যান্য দেশগুলোতে চিকিৎসক (doctor), রোগী (patient), ফার্মাসিস্ট (pharmacist) ও নার্সের(nurse) সমন্বয়ে একটি মিশ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দ্বিস্তর ভিত্তিক। এখানে রোগীর সাথে কেবলমাত্র ডাক্তারদেরই সরাসরি সম্পর্ক থাকে। ঔষধের ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যবর্তী যোগসূত্র হিসেবে ফার্মাসিস্টদের যে ভূমিকা থাকার কথা ছিল বাংলাদেশে এখনও তা খুবই অপ্রতুল। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের প্রায়ই ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও কার্যকারিতা কম দেখা যায়। ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্যসেবার পিছে ব্যয় বেশ বেড়ে যায় এবং রোগীর স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এটি বেশ উদ্বেগজনক একটি ব্যাপার। এই সমস্যার সমাধানে আমাদের কিছু করণীয় ভেবে রাখা উচিত।
- রোগীকে প্রেসক্রিপশন দেওয়ার সময় তার আর্থসামাজিক অবস্থা ও ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করে ঔষধ প্রদান।
- যতটুকু সম্ভব কম ঔষধ প্রদান করা।
- রোগীর পূর্ববর্তী মেডিক্যাল হিস্ট্রি পর্যালোচনা করে তারপর ডায়াগনোসিস ও ঔষধ প্রদান।
- ঔষধ প্রদানের সময় রোগীর ইচ্ছে, সুবিধা বা আকাঙ্খার উপর গুরুত্ব দিয়ে রোগীকে প্রেসক্রিপশন মেনে চলতে উৎসাহিত করা।
- প্রেসক্রিপশনে ঔষধ গ্রহণের নিয়মকানুন লিখে দেওয়ার পাশাপাশি মৌখিকভাবেও রোগীকে সচেতন করে দেওয়া।
- ঔষধ গ্রহণের পর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (side effects) দেখা গেলে চিকিৎসক বা ফার্মাসিস্টকে জানাতে উৎসাহিত করা।
- নিরক্ষর, প্রবীণ কিংবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক রোগীর জন্যে মেডিসিন কনটেইনারের ব্যবস্থা করা যেখানে সকাল, দুপুর, রাতের ঔষধের আলাদা আলাদা বক্সে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
- প্রতিটি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে, তৃণমূল পর্যায়ে (নূন্যতম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে) ক্লিনিকাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগদানপূর্বক ঔষধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ড্রাগ ইন্টারেকশন নিয়ন্ত্রনে আনা।
- ফার্মেসীগুলোতে বাধ্যতামূলক গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের আইন প্রণয়ন করে রোগীকে ঔষধের গুনাগুণ, ব্যবহারবিধি ও গ্রহণ শিডিউল সম্পর্কে জানানোর সিস্টেম চালু করা।
- ঔষধের সঠিক ও পরিমিত ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনকল্পে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মশালা আয়োজন করা।
তথ্যসূত্র
- Raynor DK. Patient compliance: the pharmacist’s role. International Journal of Pharmacy Practice. 1992 Mar;1(3):126-35.
- Raynor DK. The influence of written information on patient knowledge and adherence to treatment. adherence to treatment in medical conditions 2020 Jul 24 (pp. 83-111). CRC Press.
- Hamrosi KK, Raynor DK, Aslani P. Enhancing provision of written medicine information in Australia: pharmacist, general practitioner and consumer perceptions of the barriers and facilitators. BMC Health Services Research. 2014 Dec;14(1):1-0.
[…] পেশেন্ট কমপ্লায়েন্স বা অনুবর্তিতা হল স্বাস্থ্য রক্ষা ও পরিচর্যার একটি মূল ধারণা। এটি ডায়াবেটিস সহ স্বাস্থ্য পরিষেবার সমস্ত ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে৷ নন-কমপ্লায়েন্স অথবা অ-সম্মতি পূর্বে অনেক রোগীর সাথে সংযুক্ত একটি প্রেক্ষাপট ছিল। গত কয়েক দশক ধরে রোগীর ডাক্তার এবং অন্যান্য হেলথ প্রফেশনাল কর্তৃক প্রদানকৃত নিয়মকানুন মেনে চলাকে কেন্দ্র করে করে প্রচুর পরিমাণে গবেষণা হয়েছে যা পেশেন্ট কমপ্লায়েন্সকে (patient compliance) প্রভাবিত করে এমন অনেক কারণকে প্রকাশ করেছে। […]