ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট বা ভেপিং সম্পর্কে জানুন

ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট সম্পর্কে কতটুকু জানেন?

637 বার পড়া হয়েছে

ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট ব্যাটারি চালিত এক ধরনের যন্ত্র বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস। এই ডিভাইসের ভেতরে থাকে নিকোটিনের দ্রবণ, যা ব্যাটারির মাধ্যমে উত্তপ্ত হলে ধোঁয়া তৈরি হয়, যা মস্তিষ্কে ধূমপানের মতো মাদকীয় অনুভূতির উদ্রেক করে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা যন্ত্রের মাধ্যমে এ ধরণের ধূমপানকে ভ্যাপিং (vaping) ও বলা হয়ে থাকে।       

সাধারণত যারা ধূমপান বর্জন করতে চান, তারা অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকে থাকেন। গত এক দশক ধরে সারা বিশ্বে ই-সিগারেট  বা ইলেকট্রনিক সিগারেটের (e-cigarette) প্রচলন চালু হয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ই-সিগারেটের  উৎপাদন ও ব্যাবহারও নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। ভারতে ই–সিগারেট উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কানাডাসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ। অন্যদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে ২০১৯ সালে নিউইয়র্ক ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করে। বিশ্বে খুব ধীরগতিতে সাধারণ ধূমপায়ীর সংখ্যা কমছে। এ সংখ্যাটি এক বিলিয়নের বেশি। তবে ই-সিগারেটের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর ব্যবহারকারী দ্রুত বাড়ছে। ২০১১ সালে ই-সিগারেট ব্যবহারকারী ছিলেন ৭ মিলিয়ন আর ২০১৮ সালে এটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ মিলিয়ন। গবেষণা বলছে বিশ্বে ২০২২ সাল নাগাদ ই-সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৬০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।    

যদিও ই-সিগারেটে কি রয়েছে এটা এখনও পরিষ্কার নয়। কারণ ই-সিগারেট তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ দেখভাল করা বা তদারকির জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো নির্ধারিত স্টান্ডার্ড বা মানদন্ডও। এছাড়া এটা কী কী উপাদান দিয়ে তৈরি হয় সে সম্বন্ধেও কোনো স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না। তবে ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এর এক রিভিউর ফলাফলে দেখা গেছে, ১৮টি বিভিন্ন ই-সিগারেটের কয়েকটির মধ্যে টক্সিক (toxic) এবং কারসিনোজেনিক (carcinogenic) ক্যামিক্যাল বা ক্যানসার তৈরিকারক উপাদান পাওয়া গেছে, যার মধ্যে নিকোটিনও রয়েছে। যদিও উক্ত ফলাফলে বলা হয়েছে, ই-সিগারেট তৈরির মান নির্ণয়ের পদ্ধতিটি যথার্থ নয়।           

যারা ই-সিগারেট সেবন করেন তাঁদের নানাবিধ স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। যদিও ই-সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা এখনো অজানা। এ নিয়ে নেই কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা। দি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ই-সিগারেটে আছে জীবাণুনাশক ফরমালডিহাইড, যা মানব শরীরে ক্যানসার তৈরি করে। এদিকে ক্যালিফোর্নিয়া হেলথ ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ই-সিগারেট মানুষের জন্য অত্যন্ত হুমকি স্বরূপ এবং এটিকে আইনের আওতায় আনা উচিত।

তাছাড়া ই-সিগারেট কতটা নিরাপদ কিংবা স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু ঝুকিপূর্ণ এ বিষয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট ওয়েবএমডিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ই সিগারেটে ই-লিকুইড, নিকোটিন, ফ্লেভারিংস, প্রোপাইলিন গ্লাইকোল (পিজি), গ্লিসারিন ও ধোয়া তৈরির তরল উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে ই-লিকুইড অথবা ই-জুস এমন এক ধরনের দ্রবণ যেগুলো তাপ উৎপাদন করে এবং অ্যারোসোলে পরিনত হয়, যা পরবর্তীতে বাষ্পায়িত হয়ে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করে।

ই-সিগারেট এবং সাধারণ সিগারেট দুই ধরনের সিগারেটেই নিকোটিন নামক নেশা জাতীয় দ্রব্য থাকে, যা মস্তিস্কের মধ্য স্নায়ুতে উদ্দীপকের কাজ করে। এটি রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দন বাড়ায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ সাধারণত ধূমপান করে নিকোটিনের কারণে। নিকোটিন নেশা তৈরি করলেও এটি ক্যানসার তৈরির কারণ নয়। কিন্তু ই-লিকুইডে থাকা  অন্যান্য উপাদানসমূহ বেশ উদ্বেগজনক।

প্রায় একশোরও বেশি স্বাদের ই-সিগারেট রয়েছে। এর মধ্যে চেরি, চিজ কেক, সিনামোন, টোবাকো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য, যা সাধারণত বিভিন্ন ধরণের ঘ্রাণযুক্ত খাবারে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ডায়াসেটিল রয়েছে। এটি সাধারণত পপকর্নের মাখনযুক্ত গন্ধ তৈরি করে। গবেষকদের মতে, এর সাথে ফুসফুসের রোগের একটি যোগসূত্র রয়েছে এবং এটি বেশ ক্ষতিকারক।

প্রোপাইলিন গ্লাইকোল (propylene glycol) গবেষণাগারে ব্যবহৃত এক প্রকার লিকুইড, যা খাদ্য, ওষুধ এবং কসমেটিক জাতীয় পদার্থ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এটি রক-কনসার্টে কৃত্রিম ধোঁয়া তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। এটি ফুসফুস এবং চোখে বিরক্তির উদ্রেক করে। এছাড়া ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ, যেমনঃ অ্যাজমা (asthma) ও এমপাইসিমা (emphysema) এর  জন্য দায়ী। গ্লিসারিন গন্ধহীন এবং বর্ণহীন  তরল বস্তু, যা অনেকটা মিষ্টি স্বাদের হয়। এটি বিভিন্ন রকম পণ্যে দেওয়া হয়।

ই-সিগারেটে ধোয়া তৈরির জন্য এক ধরনের ই-লিকুইড বা তরল ব্যবহার করা হয়। এই ধোয়া শরীরের রক্ত সঞ্চালনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। গবেষকদের মতে, এমন ক্ষতি আসল সিগারেটেও হয় না। এছাড়া ই-সিগারেটে রয়েছে ফরমালডিহাইড ও এসিটালডিহাইড নামক দুটি রাসায়নিক পদার্থ। এই দুটি উপাদান ই-লিকুইডের তাপমাত্রা বাড়ায়, ফলে আরো নিকোটিন তৈরি হয়। এর মধ্যে থাকা একরোলিন নামক রাসায়নিক উত্তপ্ত গ্লিসারিন থেকে গঠিত, যা ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

ই-সিগারেটের এরোসোল শরীরের শিরাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শরীরে বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং স্নায়ুর ওপর প্রচন্ড চাপ ফেলে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত বা টক্সিক ধাতু, যেমন: টিন, নিকেল, ক্যাডমিয়াম, লেড ও মারকারি ই-সিগারেটের এরোসোলের মধ্যে পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে তরুণসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ সিগারেটের বিকল্প হিসেবে দিন দিন ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছেন। তবে আশার বিষয় বাংলাদেশে ই-সিগারেট ও এর বিভিন্ন উপাদান সরাসরি উৎপাদিত হয় না। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয় যা পরে ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। আইনে এ সংক্রান্ত বিধি নিষেধ না থাকায় বাংলাদেশে ই-সিগারেট আমদানি ও বিপণন নিষিদ্ধ নয়। আইনটি আবার সংশোধন করার কার্যক্রম চলমান। এতে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বর্তমান আইনে নিষিদ্ধ না হওয়ায় এর মান নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারিতেও সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোন ভূমিকা নেই।        

গবেষকদের মতে, সিগারেটের চেয়ে ই-সিগারেটে নিকোটিন বেশি পরিমাণে বের হয় বিধায় এতে আসক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে ব্যাপক হারে ছড়ানোর আগে এখনই সরকারের উচিত ই-সিগারেট আমদানি, বাজারজাত ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষনা করা। উল্লেখ্য, চলতি বছরের মার্চের দিকে ই-সিগারেটের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধের জন্য চিঠি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেন ১৫৩ জন সাংসদ।

ঢাকা শহরের  বিভিন্ন বিপণি বিতানে ই-সিগারেটের যন্ত্র ও এর উপাদান কিনতে পাওয়া যায় বলে প্রায়ই জানা যায়। কোথাও কোথাও ভ্যাপিং ক্লাবও রয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও এ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। এগুলো মূলত চীন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে, যা ৫৫০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকার মধ্যে কিনতে পাওয়া যায়।   

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, ই-সিগারেট এবং বিভিন্ন ভ্যাপিং নেয়া আনুষাঙ্গিক ধূমপান করা সিগারেটের চেয়ে কম বিপজ্জনক কারণ এতে তামাক থাকে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ধূমপান ত্যাগ করতে চান, ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং কি তাদের জন্য একটি বিকল্প সমাধান ? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ই-সিগারেটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে সিগারেটের ব্যবহার হ্রাস করে না এবং খুব কমই দেখা যায় যে, যারা ই-সিগারেট সেবন করেন তাদের সফলভাবে ধূমপান ত্যাগ করা সম্ভবপর হতে পারে। এর ফলে ই-সিগারেট ব্যবহার নিকোটিনের অভ্যাস ধরে রাখে। ধূমপানের আসক্তিমূলক বৈশিষ্ট্যগুলি কেবল নিকোটিনকেই প্রভাবিত করে না বরং ধূমপানের সাথে সম্পর্কিত আচরণ এবং পরিবেশগত সংকেতগুলিকে প্রভাবিত করে, যা ই-সিগারেটের ব্যবহার অনুকরণ করে। (সংকলিত পোস্ট)

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা লিখছি এই বিভাগে। অন্যান্য বিভাগের মত এখানে শতভাগ নতুন এবং অরিজিনাল আর্টিকেল প্রকাশ না করলেও আমরা কোন একটি মিডিয়া থেকে হুবহু কোন আর্টিকেল কপি না করে অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সংকলন করছি কয়েকটি মিডিয়া থেকে এবং পরিমার্জন ও পরিবর্ধন শেষে প্রকাশ করছি।
আমাদের প্রকাশিত কোন তথ্যে আপনার আপত্তি থাকলে আমাদেরকে দ্রুত জানাতে অনুরোধ করছি, অবশ্যই আমারা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

1 Comment

  1. […] ইপিক্যাক সিরাপ এর সাথে অ্যালকোহল বা তামাক ব্যবহার করলেও মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে। খাদ্য, […]

একটি প্রত্যুত্তর করুন

Your email address will not be published.